বিস্ফোরক পরিদপ্তরে দুর্নীতির মহাবিস্ফোরণ
ঘুষের বস্তা খুলে হিসাব মেলাতে ব্যস্ত রব

বিশেষ প্রতিনিধি: নাম আব্দুর রব। তিনি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের একজন পরিদর্শক। বর্তমান কর্মস্থল সিলেট। তবে প্রেষণে আছেন ঢাকায়। ১৯৯৪ সালে তিনি উচ্চমান টিএ (টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট) পদে চাকরিতে যোগদান করেন। তখন তার সর্বসাকুল্যে মাসিক বেতন ছিল প্রায় ১৬শ টাকা। দুই দফায় পদোন্নতি পেয়ে এখন তিনি গুরুত্বপূর্ণ এই পরিদপ্তরের পরিদর্শক। বর্তমান পদে তার মূল বেতন ৩৮ হাজার ৮৯০ টাকা। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ এখন সর্বসাকুল্যে পাচ্ছেন ৫৬ হাজার ৩৯০ টাকা। চাকরির শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত চিকিৎসা ও বাড়িভাড়াসহ মোট বেতনভাতা পেয়েছেন প্রায় ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভবিষ্যতহবিল, কল্যাণ তহবিল ও যৌথ বিমায় কেটে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। এসব বাদ দিয়ে তার নিট বেতন উত্তোলন ৫৭ লাখ টাকার কিছু বেশি। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন শুধু দলিলমূল্যেই এই কর্মকর্তার সম্পদ পেয়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকার। যদিও বেনামি সম্পদ যুক্ত করলে অন্তত শতকোটি টাকার মালিক তিনি। তার ঘুসের পরিমাণ এতই বেশি যে, বস্তায় ভরে সেই টাকা রাখতে হয় তাকে। অপর দিকে দুদকের হিসাবের তালিকায় ঢাকার কল্যাণপুরে সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর ৮তলা বাড়িও আছে এই টাকার কুমিরের। এত সম্পদ করার পরও ২০১৯ সাল পর্যন্ত তার সোনালী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে (৪৪৩২১৩৪০৪১১৪৫) জমা আছে ৩৫ লাখ ৫৩ হাজার ১৬৮ টাকা। এছাড়া শুধু রাজবাড়ী এবং একই জেলার পাংশা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তিনি ৫১টি দলিলে কোটি কোটি টাকার জমি কিনেছেন।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কেএম ইমরুল কায়েস এই আব্দুর রবের সব সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, কোনোমতেই এই সম্পদ হস্তান্তর বা বিনিময় করা যাবে না। ব্যাংকের অবরুদ্ধ হিসাবে টাকা জমা হবে। কিন্তু উত্তোলন করা যাবে না। মিরপুরে বাড়ি ছাড়াও ৫১টি পৃথক দলিলে কেনা সম্পত্তি ক্রোকপূর্বক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশও দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি আদালতের আদেশের বিষয়টি বাস্তবায়ন করেন আব্দুর রবের দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. আবুবকর সিদ্দিক। তিনি দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক। অভিযুক্ত আব্দুর রবের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার গানবুথুনদিয়া গ্রামে।
আয়-ব্যয়ে ভয়াবহ অসংগতি : সাবরেজিস্ট্রি অফিসে কাজ করেন এমন একজন দলিল লেখকের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, বাস্তবে বেশির ভাগ স্থানে দলিল মূল্যের কয়েক গুণ বেশি দরে জমি কেনাবেচা হয়। সরকার মৌজাভিত্তিক নির্ধারিত রেজিস্ট্রি ফি নির্ধারণ করে দিলেও অনেক স্থানে সরকারি দরের থেকে জমির মূল্য কয়েক গুণ বেশি। যেমন ঢাকা শহরে এখনো সরকারি হিসাবে যেসব ফ্ল্যাটের মূল্য ৫০ লাখ টাকা, বাস্তবে তার দাম কমপক্ষে দেড় কোটি টাকা। এজন্য ক্রেতারা লাভবান হন। ক্রেতাদের কালো টাকা এখানে ঢুকে জায়েজ হয়ে যায়। আব্দুর রবও এ সুযোগ নিয়েছেন। তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া জমির রেকর্ডপত্রে দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালে রাজবাড়ীর বামুন্দিয়া মৌজায় ৪ জনে মিলে প্রথম ১৮ শতক জমি কেনেন। ওই বছরের ৭ এপ্রিল পাংশা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সম্পাদিত ২৬৫৩নং দলিলে আব্দুর রবের অংশ কিনতে লেগেছে মাত্র ২ হাজার টাকা। ওইদিনই ২ হাজার টাকায় একই মৌজায় ২৬৫২নং দলিলে আরও ৫ শতক জমি কিনেন তার নিজ নামে। ওই বছর ৪ আগস্ট ২৬২৮নং দলিলে একই মৌজায় ৮ হাজার টাকায় কিনেছেন ১১ শতক জমি। তখন তিনি বেতন পেতেন ২ হাজারের একটু বেশি। এই হিসাবে তিনি ওই বছর বেতন পান প্রায় ২৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু জমি কিনতেই ব্যয় করেছেন সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এটি অবশ্য দলিলমূল্য। নিশ্চয়ই বাস্তব দাম আরও বেশি।
২০০২ সালের ৯ জুলাই পাংশার পুরান শিকজান মৌজায় ৬৪৬৬নং দলিলে ১৭ শতক জমি কেনেন ৯০ হাজার টাকায়। ওই সময় তিনি বেতন পেতেন ২৩শ টাকার মতো। এই হিসাবে দুটি ঈদ বোনাসসহ বছর শেষে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৩২ হাজার টাকার কিছু বেশি। ২০০৩ সালে ১২টি দলিলে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৫০ টাকা মূল্যে জমি কিনেছেন আব্দুর রব। ওই বছর তিনি মাসিক ২২শ টাকা হিসাবে বছর শেষে পেয়েছেন ৩০ হাজার টাকা। ২০০৪ সালে পৃথক ৬টি দলিলে ৮১ হাজার টাকার জমি কিনেছেন তিনি। ওই বছর তার মাসিক বেতন ২ হাজার ৩০০ টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় প্রায় ৩২ হাজার টাকা। ২০০৫ সালে পৃথক ৩টি দলিলে ৪৩ হাজার ৫০০ টাকার জমি কিনেছেন। তখন তার মাসিক বেতন ২৪শ টাকা। এ বছর শেষে পেয়েছেন ৩৪ হাজার টাকা। ২০০৬ সালেও ৭ হাজার টাকা দলিলমূল্যে ৬ শতক জমি কিনেছেন। ২০০৮ সালে ৩টি দলিলে জমির দাম ৭৬ হাজার টাকা উল্লেখ করে জমি কেনেন তিনি। ওই বছর তার বেতন ছিল ৫ হাজার ৬৬০ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে তিনি পেয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার টাকা। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিদর্শক হন আব্দুর রব। এরপর ২০১৩ সালে ঢাকার কল্যাণপুরে রেজিস্ট্রিসহ ১ কোটি ৩৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় সাড়ে তিন কাঠা জমি কেনেন আব্দুর রব। বছর শেষে তার নিট আয় তখন প্রায় ১ লাখ টাকা। আবার পরের বছর ২০১৪ সালে পৃথক ৫টি দলিলে আব্দুর রব কিনেছেন রাজবাড়ী সদরে ৩৩৩ দশমিক ১৬ শতক জমি, যার দলিলমূল্যই উল্লেখ করা হয় ২৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। ওই বছর তার মাসিক বেতন সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এই হিসাবে বছর শেষে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় ১ লাখ টাকার কিছু বেশি। ২০১৫ সালে রাজবাড়ী সদরে দুটি দলিলে ১৪ দশমিক ৮৬ শতক জমি কিনেছেন, যার দলিলমূল্যই দেখানো হয়েছে ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অন্য দিকে ঢাকার জমিতেও ৮তলা ইমারত বানাতে শুরু করেন রব। ওই বছরই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করে সরকার। তখন তার বেতন বেড়ে হয় ২৯ হাজার টাকা। এই হিসাবে বছর শেষে তার অ্যাকাউন্টে যায় ৪ লাখ ৬ হাজার টাকা। ২০১৬ সালে রাজবাড়ী সদরে ও বালিয়াকান্দিতে মোট ৫টি দলিলে জমি কিনেছেন ৫৩ দশমিক ৯ শতক। যার দলিলমূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ২৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা। ২০১৬ সালে তিনি বেতন পেয়েছেন ৩০ হাজার ৪৫০ টাকা। এই হিসাবে বছর শেষে সেলারি অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৭ সালে রাজবাড়ী সদরে ১১৮ দশমিক ৬২ শতক জমি কিনেন এই কর্মকর্তা। যার দলিলমূল্য দেখানো আছে ৭৫ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। ওই বছর তার বেতন ৩১ হাজার ৯৮০ টাকা। বছর শেষে পেয়েছেন ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭২০ টাকা। ২০১৮ সালেও রাজবাড়ী সদরে ৫৬ দশমিক ৬ শতক জমি কিনেছেন এই পরিদর্শক। যার দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ওই বছর তার বেতন ৩৩ হাজার ৫৮০ টাকা। বছর শেষে পেয়েছেন ৪ লাখ ৭০ হাজার ১২০ টাকা। সর্বশেষ ২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই বছরও রাজবাড়ী সদরে জমি কিনেছেন বিপুল টাকার মালিক এই আব্দুর রব। ওই বছর পৃথক তিনটি দলিলে ২২ লাখ ৪ হাজার টাকায় ১ একর ৪৬ শতক জমি কেনেন এই কর্মকর্তা। ২০১৯ সালে আব্দুর রবের বেতন ৩৫ হাজার ২৬০ টাকা। সারা বছরে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪০ টাকা।
ঢাকায় বাড়ি : মিরপুরের বড় সায়েক মৌজায় ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের নকশায় কল্যাণপুর ২নং প্রজেক্টের বি-১৬ প্লটটির মালিকও আব্দুর রব। ২০১৩ সালের ১০ মার্চ ১ কোটি ৩৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় মিরপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্লটটি রেজিস্ট্রি হয়। দলিল নং ২৫৮৬। ওই প্লটে ৮ তলা ভবনও বানিয়েছেন তিনি। এই ভবন নির্মাণে ৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রাথমিক খরচও পাওয়া গেছে।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান : দুদক আব্দুর রবের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে। মাত্র তিন মাসের অনুসন্ধানে তার অবৈধ সম্পদের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর তার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ চেয়ে মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে আবেদন করেন দুদকের উপপরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. আবুবকর। ওই আবেদনের এক স্থানে তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক আব্দুর রব শুধু ঢাকা মহানগর এলাকায়ই ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৬ টাকার স্থাবর সম্পত্তি অর্জন করেছেন, যা ঘুস ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত এবং জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে উৎসবহির্ভূত সম্পত্তি। যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এবং ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। এই সম্পত্তি ক্রোক করা না হলে অনুসন্ধান নিষ্পত্তির আগেই হস্তান্তর বা বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি বিচার কাজে তা বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না।’ এই আবেদনের বিষয়টি আমলে নিয়ে শুনানি শেষে আব্দুর রবের সব সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন আদালত।
গত বছরের ৮ জানুয়ারি অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. আবুবকর একই আদালতে আরেকটি আবেদন করেন। এই আবেদনে তিনি বলেন, আব্দুর রবের বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণ করে বিস্ফোরক আমদানি ও পরিবহণের লাইসেন্স দেওয়া, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে মাসোহারা আদায় করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। অনুসন্ধানকালে তার নিজ নামে রাজবাড়ী, পাংশা ও বালিয়াকান্দিতে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৫ হাজার ২৫০ টাকার স্থাবর সম্পত্তি অর্জন করেছেন। ওই আবেদনে ৫১টি দলিলে প্রকাশিত তথ্য উপস্থাপন করে ক্রোকাদেশ চাওয়া হয়। বিচারক এই আবেদনটি গ্রহণ করে স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালকের কছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে এসব সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট এলাকার রেজিস্ট্রার ও সাবরেজিস্ট্রারদের অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঘুস বাণিজ্যের সাক্ষী স্ত্রী : তথ্যানুসন্ধানে আব্দুর রবের এক স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। তার নাম ফাতেমা খাতুন ইতি। বাড়ি আব্দুর রবের একই এলাকায়। তিনি ঢাকায় একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। বর্তমানে তিনি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায়ই তাকে তালাক দিয়েছেন আব্দুর রব। নিজেকে নির্যাতনেরও অভিযোগ করেছেন ইতি। ২৯ জুন তিনি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে এ বিষয়ে একটি অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগের এক স্থানে আব্দুর রবের নামে-বেনামে উপার্জিত সম্পদ ও ঘুষের উৎস সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, আব্দুর রব বিস্ফোরক পরিদপ্তরের একজন পরিদর্শক হিসাবে অবৈধভাবে সিএনজিসহ বিভিন্ন ফিলিং স্টেশনের লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। একটি ফিলিং স্টেশনের লাইসেন্সপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ২৬ শতক জমি। কিন্তু সরেজমিন গেলে দেখা যাবে তার হাতে সুপারিশকৃত পাম্পের একটিতেও নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি নেই। তদন্ত হলে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হবে। এছাড়া সনদ প্রদান ও নবায়ন বাবদ এসব স্থান থেকে বিপুল অঙ্কের ঘুস গ্রহণ ছাড়াও প্রতিমাসে তার কাছে মসোহারা পাঠানো হয়। এছাড়া জাহাজ কারখানা, গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, অক্সিজেন সিলিন্ডার, গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিস্ফোরক অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত সব জায়গা থেকে মাসোহারা আদায় করা হয়।
বেনামি সম্পদের কথা উল্লেখ করে ইতি বলেন, গাজীপুর ও কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে তার টাকায় কেনা সম্পত্তি আছে। ময়মনসিংহে আছে মৎস্য খামার। আছে তেলের লরিও। তার ছোট বোনের স্বামী সুফিয়ার ময়মনসিংহের মাছের খামার পরিচালনা করেন।অনুসন্ধানেও এসব তথ্যের সত্যতা মিলেছে। খিলগাঁও নন্দিপাড়ায় আছে এলপিজি স্টেশনের জন্য জমি। সরেজমিনে পম্পের জন্য নির্ধারিত জমির দেখা পেলেও এর মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সম্প্রতি তিনি তার গ্রামের বাড়ির পাশে শিকজান প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন জমি কিনেছেন। এই জমি বাবদ জমির মালিককে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানের কারণে সেই জমি রেজিস্ট্রি করা হয়নি। তবে দাম পরিশোধ করা হয়েছে। তার নিকটাত্মীয়দের ব্যাংক হিসাব তলব করলেই আব্দুর রবের অবৈধ অর্থসম্পদ অর্জনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে। সিনিয়র সচিবকে লেখা চিঠিতে তিনি এমন দাবি করেন।
দুদকেই সর্বনাশ : তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আব্দুর রবকে সামনে রেখে বিস্ফোরক পরিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই পরিদপ্তর থেকে সারা দেশে সিএনজি, এলপিজি ও পেট্রোল পাম্প ছাড়াও জাহাজ কারখানা, গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, অক্সিজেন সিলিন্ডার, গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিস্ফোরক পরিদপ্তর সনদ দেওয়া হয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই সুযোগে সেবাপ্রত্যাশী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মানুষকে জিম্মি করে অনেকটা নীরবেই কোটি কোটি টাকা ঘুস আদায় করা হয়। ঘুস ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না। আবার সনদ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করেই অবৈধ উপায়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক সনদ নিয়েছেন। এ কারণে অগ্নিকাণ্ডসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনাকারীরা আব্দুর রবের মতো কর্মকর্তাদের মাসোহারাও দিয়ে থাকেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সাবেক প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলমসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এই ১৬ জনের মধ্যে ৭ নম্বরেই আছে আব্দুর রবের নাম। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলো-অনুসন্ধান কাজ শেষ করে ১৭ জুন এ সংক্রান্ত ফাইল নথিজাত করা হয়। দুদকের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক গোপনীয় চিঠিতে আলোচ্য ১৬ জনের বিষয়ে বলা হয়, ‘বর্ণিত অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রমাণিত না হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তা পরিসমাপ্তি করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুর রবের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. আবুবকর সিদ্দিকবলেন, ‘কিছু অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু বিষয় নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়েছে।’
সরল স্বীকারোক্তি : অভিযুক্ত বিস্ফোরক কর্মকর্তা আব্দুর রব বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত ঘুস, দুর্নীতি ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অনেক কিছু অকপটে স্বীকার করেন। যার অডিও-ভিডিও একটি জাতীয় পত্রিকার কাছে সংরক্ষিত আছে। তিনি বলেন, ‘ওয়ারিশ সূত্রে পিতার সম্পদ এবং চাকরি থেকে পাওয়া আয় দিয়ে তিনি নিজের নামে এত সম্পত্তি করতে পেরেছেন।’ তবে তার দাবি, ‘দুদক অনুসন্ধান করে তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তাদের ১৬ জনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিষ্পত্তি করে দেওয়া হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজের জন্য যারা টাকা দেন, তারা এসব নিয়ে কথা বলেন না। যারা দেন না, তারাই বেশি প্রচার করেন।’ একপর্যায়ে প্রতিবেদককেও টাকা দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন, ‘আমার কাছে এসে কেউ খালি হাতে গিয়েছে, সেরকম নজির নেই।’
বিপুল অঙ্কের টাকার পাশে বসা অবস্থায় ছবি প্রসঙ্গে রব বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার ছবিই এটা। টাকাগুলো আমার বাসা থেকে বস্তাভর্তি অবস্থায় চুরি করে নেন আমার সাবেক স্ত্রী। এছাড়া চুরি করে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকেও বেশকিছু টাকা চুরি হয়। মান-ইজ্জতের ভয়ে সেই টাকা আর আদায় করতে পারিনি। তবে যা পাওয়া গেছে তা ১৫/১৬ লাখ টাকা হবে। ছবিটি টাকা উদ্ধারের সময়ের।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *