কালিগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্যে ‘শেরেস্তা’ না দিলে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয় না

হবিবুল্লাহ বাহার হাবিব, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরা কালিগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একশ্রেণির দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন সেবা প্রত্যাশীরা। দলিল লেখক, স্ট্যাম্প ভেন্ডার ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এ সিন্ডিকেটের যোগসাজশে সাব-রেজিস্ট্রার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলিয়ে সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন দেখিয়ে, সাব-কবলা দলিলের পরিবর্তে হেবাবিল এওয়াজ, অসিয়ত নামা, ঘোষণাপত্র, আমমোক্তার নামা দলিল রেজিষ্ট্রি করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সাব-রেজিস্ট্রার এ অফিসে যোগদানের পর থেকে এ দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি দলিল থেকে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা শেরেস্তার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ টাকা দলিল লেখক সমিতি, মসজিদ ও বিভিন্ন জাতীয় দিবসের চাঁদা ছাড়া বাকি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা করে আত্মসাত করা হচ্ছে। ওই টাকা দিয়ে দলিল লেখকদের কেউ কেউ জমিয়েছেন ব্যাংকে কাড়ি কাড়ি টাকা। গড়েছেন আলিশান বাড়ি। চলেন রাজকীয় স্টাইলে। অপরদিকে দলিল লেখকদের কাছে থেকে ওই অতিরিক্ত টাকার ভাগ নিয়ে লাখোপতি সাব-রেজিস্টার।
সরেজমিন সাব-রেজিস্টারের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, জমির ক্রেতাদের দলিল রেজিষ্ট্রির কাজে এজলাশে সাব-রেজিস্টার ব্যস্ত থাকলেও ঐ রুমে অফিসের কর্মচারী প্রদাপ কুমার ঘোষের কাছে নগদ টাকা দিচ্ছেন দলিল লেখকদের সহযোগিরা। সাব-রেজিস্টারের সামনেই এমন ঘুষের লেনদেন নিত্য নতুন নয়। হঠাৎ প্রদীপ কুমার ঘোষ সাংবাদিকদের দেখে তাড়াহুড়া করে ড্রয়ারে টাকা রেখে পিছনের গোপন রুমে চলে যায়। এরপর প্রায় দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হলেও তার খোঁজ মেলেনি।
কালিগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যে সমস্ত জমির দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ দলিল হেবাবিল এওয়াজ, আমমোক্তার নামা, দানপত্র ও ঘোষণাপত্র দলিল। এতে বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরের রেজিস্ট্রি করা দলিল পরীক্ষা করলে এর সন্ধান পাওয়া যাবে বলে মনে করেন অনেকেই।
ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, দলিলের ফি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করলেও শেরেস্তার অতিরিক্ত ফি ছাড়া সাব-রেজিস্ট্রার কোনো দলিল রেজিস্ট্রি করেন না। তার চাহিদা মতো টাকা না পেলে বিভিন্ন কাগজপত্রের অজুহাতে হয়রানি করা হয়। আবার টাকা পেলে সব বৈধ হয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দলিল লেখক জানান, শেরেস্তা না দিলে জমি রেজিস্ট্রি তো দূরের কথা সীমাহীন হয়রানির স্বীকার হতে হয় ভুক্তভোগীদের। তাই বাধ্য হয়েই শেরেস্তার অতিরিক্ত ফি দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়। তবে কাগজপত্রে ঝামেলা থাকলে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রত্যেক দলিল থেকে শেরেস্তার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হলেও সিন্ডিকেটের ভয়ে এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছে না।
জমির ক্রেতাদর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা ও সাব-রেজিস্টার অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার বিষয় অস্বীকার করে কালিগঞ্জ দলিল লেখেক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুর আব্দুল বিশ্বাস জানান, আমাদের লেখকদের মধ্যে বিভক্তি। সেজন্য আমাদের অনুমতি না নিয়ে সাব-রেজিস্টার কারো সাথে কথা বলেন না। সাংবাদিক থেকে শুরু করে এখানে কেউ আসলে আগে আমাদের সাথে দেখা করে। তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে আমারা সহযাগিতা করি। আপনারা আমাদের সাথে দেখা না করে কেন সাব-রেজিস্টারের সাথে দেখা করতে গেলেন। তার সাথে আপনারা দেখা করা মানে আমাদের সম্মান নষ্ট করা। তিনি আরও জানান, আপনাদের পরিচয় কি? আপনারা কিসের সাংবাদিক? থানায় খবর দিয়েছি পুলিশ আসছে। আপনারা বসেন। এত সাহস আপনারা কই পেলেন। আপনাদের পত্রিকা মানুষ পড়ে না, পড়ে তো চাঁদের মানুষ। পারলে অন্য জায়গায় নিউজ সংগ্রহ করত যান। আমাদের এখানে আপনাদের আসার দরকার নেই। আমাদের এখানে অনেক নামিদামি সংবাদকর্মীরা আসেন। তাদেরকে আমরা বিভিন্নভাবে সহযাগিতা করি।
বিষয়টি অস্বীকার করে কালিগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্টার এস এম মাস্তাফিজুর রহমান জানান, ঘটনাটি আমার জানা নেই। এ ব্যাপার জেলা রেজিস্টার মোহা: আব্দুল হাফিজ জানান, আমার কাছে অদ্যাবধি কেউ কোন লিখিত অভিযাগ করেনি। আপনাদের কাছ কোন প্রমাণ থাকল আমার কাছে দেবেন। ঘটনাটি তদন্তÍ করে দেখব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *