জাতীয় জরুরি সেবা ও বিপদের বন্ধু “৯৯৯” দুই বছরে পদার্পন
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেক্স: বঙ্গোপসাগরে পায়রা বন্দরের অদূরে ডুবতে থাকা জাহাজ থেকে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন তাজিম আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় তিনি জানান, ‘এমভি গালফ আরগো’ নামের জাহাজে ১৫২টি কনটেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা যাচ্ছিল। পথে পায়রা ফেয়ারওয়ে বয়ার কাছে জাহাজের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। সাগর উত্তাল থাকায় জাহাজটি এলোমেলো ভাসতে ভাসতে শেষে ডুবতে শুরু করেছে। জাহাজে থাকা নাবিকদের দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে কাতর অনুরোধ জানান তিনি। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টা ৫৭ মিনিটে এই কল পাওয়ার পর ৯৯৯ থেকে তাৎক্ষণিক কোস্টগার্ড নিয়ন্ত্রণকক্ষে বিষয়টি জানানো হয়। তবে উত্তাল সাগরে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর মতো জাহাজ না থাকায় তারা নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়। এরপর নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে বিষয়টি জানানো হয়। খবর পেয়ে গভীর সমুদ্রে টহলরত নৌবাহিনীর জাহাজ সাঙ্গু ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাইফ জ্যাকেট পরে সমুদ্রে ভাসতে থাকা নাবিকদের উদ্ধার করে। এভাবেই চরম বিপদের সময় একটি মাত্র কল করে প্রাণে বেঁচে যান ১৪ নাবিক। তবে এমন ঘটনা শুধু একটি নয়। প্রত্যেক দিন ২৪ ঘণ্টা নানা প্রয়োজনে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’। বৃহস্পতিবার পূর্ণ হলো তাদের আনুষ্ঠানিক সেবার দুই বছর, শুরু হচ্ছে তৃতীয় বছরের যাত্রা। গত প্রায় দুই বছরে (৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত) তারা ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬টি কল গ্রহণ করেছে। অবশ্য এর মাত্র ২১ ভাগ ছিল সেবাযোগ্য কল, যার সংখ্যা ৩০ লাখ ৭৮ হাজার ৫১৭। বাকি ৭৯ ভাগ কলই অযথা, ভুল করে, না বুঝে, মজা বা দুষ্টুমি করে অথবা কোনো ত্রুটির কারণে করা হয়েছে। ৯৯৯-এর দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ বলেন, ‘দুই বছরে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা। সবাই এখন ৯৯৯ সম্পর্কে অবগত। এখান থেকে কী ধরনের সেবা পাওয়া যায়, তা সবাই জানেন। প্রয়োজনে তারা কল করেন এবং কাঙ্ক্ষিত সেবা পান। এর ফলে সেবাপ্রাপ্ত ব্যক্তির মধ্যে আস্থা তৈরি হয়। পরে ওই ব্যক্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানছেন তার ঘনিষ্ঠ ও পরিচিতজনরা। এভাবেই ৯৯৯ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সেবার মান আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে।’ রাজধানীর আবদুল গনি রোডে পুলিশের ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যান্ড কমান্ড সেন্টারে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ৯৯৯ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সম্পর্কিত সেবা দেওয়া হয় এখান থেকে। এই সংক্রান্ত কলগুলোকে বলা হয় কল ফর সার্ভিস বা সিএফএস। গত দুই বছরে মোট সিএফএস ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার ৫৮৯। এর মধ্যে পুলিশি সেবার জন্য ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৩৭, ফায়ার সার্ভিসের জন্য ২৬ হাজার ৮২৭ ও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ২০ হাজার ৩২৫টি কল এসেছে। এই নম্বরটি টোল ফ্রি অর্থাৎ কল করতে কোনো টাকা লাগে না। সংশ্নিষ্টরা জানান, বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রচুর মানুষ ৯৯৯ নম্বরে কল করে সহায়তা চান। এর মধ্যে তুচ্ছ বিষয় যেমন থাকে, তেমনি মারাত্মক বিপদের অনেক ঘটনাও থাকে। সব ক্ষেত্রেই কলারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়। যেমন গত ১৫ অক্টোবর বিকেলে মুন্সীগঞ্জের কাঁঠালবাড়ী থেকে শাহাবুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি ৯৯৯-এ ফোন করে জরুরি সহায়তা চান। তিনি জানান, অ্যাম্বুলেন্সে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন। কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে পৌঁছে দেখেন, লম্বা লাইনের একদম শেষে আছেন। তখন রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় তিনি অ্যাম্বুলেন্সটি দ্রুত পারাপারের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। ৯৯৯ থেকে তাৎক্ষণিক লৌহজং থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে কাঁঠালবাড়ী নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জকে জানানো হয়। ফাঁড়ির ইনচার্জ তখনই অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরিতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ২৯ মিনিটে তারেকুল ইসলাম নামে একজন মধ্য বাড্ডার আদর্শনগর থেকে কল করে পুলিশি সহায়তা চান। তিনি জানান, মধ্য বাড্ডার লুতফুন টাওয়ার থেকে একটি ছেলেকে অপহরণ করে আদর্শনগরের এক বাসায় আটকে রাখা হয়েছে। ৯৯৯ থেকে তখনই ওই ব্যক্তিকে বাড্ডা থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে হাসিব নামে এক যুবককে উদ্ধার করে। আরেক ঘটনায় দেড়শ’র বেশি যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মুন্সীগঞ্জের পদ্মা নদীতে একটি লঞ্চ বিকল হয়ে পড়ে। ভারি বৃষ্টিপাতের মধ্যে লঞ্চটি স্রোতের টানে ভেসে যেতে থাকায় যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এভাবে ভাসতে ভাসতে লঞ্চটি প্রায় ১০ কিলোমিটার চলে যায়। ১ অক্টোবর বিকেলের এ ঘটনায় ওই লঞ্চের এক যাত্রী কল করে সহায়তা চান। ৯৯৯ থেকে তখনই ওই যাত্রীকে নৌপুলিশ সদর দপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর নিয়ন্ত্রণকক্ষে কথা বলিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিটে উদ্ধারকারী লঞ্চটি পৌঁছে এবং বিকল লঞ্চের সব যাত্রীকে উদ্ধার করে। ৯৯৯ পরিচালনায় যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এটি মূলত একটি কল সেন্টার। এখানে ১০০টি ওয়ার্ক স্টেশন রয়েছে। পুলিশ সদস্যরাই এটি পরিচালনা করেন। কর্তব্যরতরা প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ১২০টি কল গ্রহণ করতে পারেন। ২৪ ঘণ্টাই এটি খোলা থাকে। এর মধ্যে দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কল আসে। এ কারণে তখন জনবলও বেশি থাকে। আর রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কল আসে সবচেয়ে কম। আবার সকাল ৬টার পর কলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নির্ধারিত তিন ধরনের সেবা ছাড়াও নানা তথ্য জানতে বা অন্যান্য প্রয়োজনেও লোকজন কল করে। দুই বছরের তথ্য অনুযায়ী নারীরা বিভিন্ন দরকারে ১ লাখ ৯৫৩ ও শিশুরা ২ লাখ ৮০ হাজার ২১৯টি কল করেছে। এ ছাড়া নানা তথ্য জানতে বিভিন্ন বয়সী মানুষ ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫৬টি কল করেছেন এবং ৩৭ হাজার ২০০টি পুলিশের ডিপার্টমেন্টাল কল রয়েছে। সিএফএস ছাড়া এই কলগুলোকেও সেবাযোগ্য কলের আওতায় ধরা হয়। এর বাইরে অকার্যকর কল এসেছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪৯টি। কল সেন্টারের কর্মীরা জানান, মূলত সিএফএস ক্যাটাগরির কলই তারা প্রত্যাশা করেন। কারণ নির্দিষ্ট ধরনের সেবা দেওয়ার জন্যই এই কল সেন্টার। তবে যে ২১ ভাগ সেবাযোগ্য কল তারা পান, এর মধ্যে মাত্র ১ ভাগ সিএফএস। উদ্বোধনের দিন ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২২ হাজার কল এসেছিল। তবে সিএফএস ছিল ২০টিরও কম। এখন প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার কল আসে, যার ২০০ থেকে ২৫০টি সিএফএস। কোনো কল এলে ৯৯৯ থেকে প্রথমে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি তার পরিচয়, কোথায় থেকে বলছেন- এসব প্রশ্ন করা হয়। তবে কল সেন্টারটির আধুনিকায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে এসব প্রশ্ন করার দরকার পড়বে না। কল আসার সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯-এর ডেস্কের কর্মীর মনিটরে তথ্যগুলো ভেসে উঠবে।