স্পেনে কপ২৫ সম্মেলন ব্যর্থ হলে ক্ষমা করবে না ভবিষ্যৎ প্রজন্ম: প্রধানমন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। এটা মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কাউকে ক্ষমা করবে না। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রয়োজন বৈশ্বিক ঐক্য।
গতকাল সোমবার স্পেনের মাদ্রিদে ‘অ্যাকশন ফর সারভাইভাল :ভালনারেবল নেশনস কপ২৫ লিডার্স সামিট’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের এই ২৫তম বার্ষিক সম্মেলন ‘কপ২৫’ নামে পরিচিত। খবর বাসস, ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আমাদের সময়ের সম্ভবত কঠিনতম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি। বিশ্ব এখন মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিমুহূর্তে আমাদের নিষ্ফ্ক্রিয়তা পৃথিবীর প্রত্যেক জীবিত মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখনই সময় কাজ করার।’ তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতা। এটি এখন মানুষের জীবন ও পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। ১৯৯২ সালে আর্থ সামিটের পর থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাসে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি, এর নির্গমন এখনও বেড়ে চলেছে। এই প্রবণতা পৃথিবীকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের মতো অনেক দেশকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে। ঝুঁকিতে থাকা আমাদের মতো দেশগুলো এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমিত ক্ষমতা এবং নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির জন্য অতি সামান্য অথবা কোনো অবদান না রাখলেও ক্ষতির ধাক্কাটা আমাদেরই সামলাতে হচ্ছে। এটি একটি অবিচার এবং অবশ্যই বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিষয়টি স্বীকার করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালের নভেম্বরে মালেতে ফোরামের প্রথম সভার পর বৈশ্বিক জলবায়ু দৃশ্যপটের যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এ ক্ষেত্রে ইউএনএফসিসিসির প্রক্রিয়ার অগ্রগতি খুব ধীর এবং অপর্যাপ্ত। বিশেষত, বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশগুলোতে জাতীয়ভাবে গ্রহণ করা অভিযোজনমূলক উদ্যোগে সহায়তা করার জন্য খুব কমই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠন করা তহবিলগুলোতে পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব রয়েছে। সরাসরি এবং সহজে তহবিল পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত ও মানদ রয়েছে, বেশির ভাগই সেসব সক্ষম দেশগুলোর পক্ষেই যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মতো সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও ধারণার চেয়েও কম সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি নতুন সিভিএফ এবং ভি-২০ ট্রাস্ট তহবিল গঠন এবং জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ দূত নিয়োগ সম্ভব হলে সেটি হবে বড় সাফল্য।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নানাভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়েছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, এর প্রভাব এবং মোকাবিলার সক্ষমতা অভাবের ওপর ভিত্তি করে দুর্বল দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি মানদ নির্ধারণ করতে হবে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নিয়মিত সমর্থন এবং আলাদাভাবে উন্নয়ন তহবিল রাখতে চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বেশি দায়ী দেশগুলোকে ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। এতে বৈশ্বিক জলবায়ু ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সুতরাং এই উদাসীনতার জবাব চাইতে দ্বিধা করা উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যাপক হারে অভিবাসনেও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে, এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত। সংঘাতের চেয়ে আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের কারণে এরই মধ্যে অনেক মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মরুকরণের মতো ধীরগতির প্রভাবের দিকেও বিশ্বের নজর কম। এই ভারসাম্যহীনতা ঠিক করতে সবার কাজ করা উচিত।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট, কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট কার্লোস আলভারাদো কুয়েসাদা, মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিলডা হেইন প্রমুখ বক্তব্য দেন।
পরে কপ২৫ সম্মেলনের সাধারণ আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এ কারণে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ হারে কম হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলাদেশে জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ বা ১ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের জীবনমান ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক।
তিনি বলেন, ঝুঁকি মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে ইউনিসেফ জানিয়েছে। এতে ২০৫০ সাল নাগাদ ১ কোটি ৯০ লাখ শিশুর জীবন হুমকিতে পড়ার আশঙ্কাও করা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমরা কখনই এসডিজি অর্জন করব না এবং দারিদ্র্যবিমোচন করতে পারব না।’
জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশে সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমরাই প্রথম একটি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল গঠন করেছি। প্রশমন ও অভিযোজনে আমরা নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪১৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে আমরা ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে প্রস্তুত আছি।’ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা বাংলাদেশ যেভাবে করছে, অন্য দেশগুলোও তা অনুসরণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের ২৫তম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে তিন দিনের সফরে রোববার স্পেন পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফর শেষে আজ রাতে তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন।
সিভিএফ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বছর ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতির দ্বায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, কপ২৫ সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিলডা হেইনের এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন।
২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের সময় মালদ্বীপ সরকার সিভিএফ গঠন করে। মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিলডা বর্তমানে সিভিএফের সভাপতি। এই ফোরামের কাজ হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতার নেতিবাচক প্রভাব চিহ্নিত করা।
ডাচ প্রধানমন্ত্রী ও ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট ও ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল। মাদ্রিদে জলবায়ু সম্মেলনের ফাঁকে এ বৈঠকে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের সমর্থন প্রত্যাশা করেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন ব্রিফ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *