সাক্ষাৎকার : দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দুর্নীতিবাজের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক: চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গত বুধবার পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৯ জনে। অভিযুক্তের তালিকায় কখন যে কার নাম যুক্ত হয় তা বলা মুশকিল। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে। এবার দুর্নীতিবাজদের সংযত হতেই হবে। গত বুধবার দুদকের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে দুর্নীতিবাজদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তাদের কাছে অনুসন্ধানের যে তালিকা আছে সেগুলো শেষ করতে অনেক সময় লাগবে। এ নিয়ে অনেকে বলছেন যে, কিছু দিন পর দুর্নীতিবিরোধী এসব অভিযান, অনুসন্ধান বন্ধ হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে এটা বন্ধ হবে না। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, গত ১৮ নভেম্বর তালিকায় দেড়শ’ জনের নাম ছিল। গত ১৯ নভেম্বর সেটা ১৬৭ জনে পৌঁছেছে। ক্রমেই তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত তালিকায় নাম এসেছে ১৬৯ জনের। তিনি বলেন, ‘আশা করছি এ তালিকার কথা শুনে দুর্নীতিবাজরা এই অপকর্ম বন্ধ করবে। আমরা চাই তারা সঠিকভাবে সঠিক কাজটি করুক। তারা যেন অনিয়ম না করে। আমরা আশা করি, আমাদের কাজ ও সরকারের ড্রাইভের কারণে হলেও দুর্নীতিবাজরা সংযত হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতির মাত্রা কমবে।’ সরকার ও দুদকের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সম্পর্কে ইকবাল মাহমুদ বলেন, সরকারের শুদ্ধি অভিযানের সঙ্গে দুদকের কার্যক্রমের সম্পর্ক নেই। দুই পক্ষই আলাদাভাবে কাজ করছে। তবে উভয়ের লক্ষ্য এক। দুদক তার শিডিউলভুক্ত অপরাধগুলো নিয়ে কাজ করছে। সরকার হয়তো ক্যাসিনো, অবৈধ অস্ত্র নিয়ে কাউকে ধরেছে। দুদক কাজ করছে, অবৈধ সম্পদ অর্জন, মানি লন্ডারিং অথবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার বিষয় নিয়ে। সরকারের অভিযানের মধ্যেই এগুলো আমরা পিকআপ করছি। সেটাও সরকার দেয় না আমাদের। সরকারের দেওয়ার সুযোগও নেই। আমরা সেগুলো গণমাধ্যমসহ অন্য কোনো মাধ্যম থেকে পেয়ে থাকি। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকেও কিছু তথ্য জানানো হয়। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিবিদসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা সরকারি কর্মচারী- আমাদের মুখ্য বিষয় নয়। আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় দুর্নীতিসংক্রান্ত ঘটনা। কমিশন কখনও কোনো নাম দেখে না। দেখে অপরাধ। অপরাধের সঙ্গে জড়িত কে? এর মধ্যে যারা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এ বিষয় নিয়ে আমাদের কখনও জিজ্ঞাসা করা হলে আমরা বিব্রত হই। আমরা ব্যক্তির নাম দেখি না। চেয়ারম্যান বলেন, সারাবিশ্বে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার তাৎপর্য রয়েছে। আমরা বিভিন্ন দেশে উচ্চপর্যায়ের কনফারেন্সে অংশ নিয়ে বুঝেছি, সবার কথা একটাই- সেটা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি দমন সম্ভব না। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট শুধু সরকারি দলের থাকলে হবে না। এ ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকল রাজনৈতিক দলের কমিটমেন্ট থাকতে হবে। অন্তত একটা জায়গায় আমাদের সবাইকে এক হতে হবে। যেমন ধরুন যখন আমাদের দেশের খেলা হয়, আমাদের ছেলেমেয়েরা জিতে যায়, তখন দল-মত নির্বিশেষে সবাই আমাদের খেলোয়াড়দের স্বাগত জানান। আপনি এমন কখনও দেখেছেন যে, পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিজয়ী খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানায়নি? আমরা এটাই চাই। চাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু যে সরকার বলবে তা নয়, ক্ষমতাসীন দল বলবে তা নয়। বিরোধী দলকেও বলতে হবে। বিরোধী দলের পরে আরও অনেক দল আছে অর্থাৎ সকল দলকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই দুর্নীতি দমন সম্ভব। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সম্পর্কে ইকবাল মাহমুদ বলেন, সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অনেকটাই আমাদের উৎসাহিত করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কখনও কখনও সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অভিযুক্তকে উল্লেখ করে বলা হয় সেগুলোর কী হবে? এ ক্ষেত্রে আমার কথা হলো- সবই হবে। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, সরকারের যে উদ্যোগ সে উদ্যোগকে আমরা জনগণের প্রত্যাশার পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি- এটা আমরা পারব। সেই সক্ষমতা দুদকের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বর্তমানে ক্ষমতায় যে সরকার তাদেরও একটা চাপ আছে, সমাজেরও একটা চাপ আছে। সমাজের চাপের কারণেই এ ঘটনাগুলো ঘটছে। আমরা আশা করি, এই চাপের কারণেই দুর্নীতিবিরোধী চলমান কার্যক্রম একটা সফল পরিণতির দিকে যাবে। গত দুই বছর ধরে ওয়াসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা তাদের সমস্যা উত্তরণের পরামর্শ দিয়ে তাদের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছেন। ওইসব প্রতিষ্ঠানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে? এর জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা মূলত যেসব প্রাতিষ্ঠানিক রিফর্মের সুপারিশ দিয়েছি। দুর্নীতি বন্ধ করতে তাদের রিফর্ম করতে হবে, পদ্ধতি পরিবর্তন হবে। এ পর্যন্ত আমরা ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠানে সুপারিশমালা পাঠিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমরা আশাবাদী। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা সুপারিশগুলো গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এটি হলে জনগণ সুফল পাবে। তবে সামাজিক পরিবর্তন খুব সহজ নয়। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বেশ সময় লাগে। আজকে সুপারিশ করা হলে কালকেই এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দুর্নীতির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি। প্রতিরোধের মাধ্যমে দুর্নীতি ধীরে ধীরে কমবে। ঘুষের প্রবণতা কতটুকু কমেছে- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘুষ এখনও আছে, তবে ঘুষ দেওয়া ও ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা আগের তুলনায় কমেছে। দুদকে আগে ৩০-৪০টি অভিযোগ আসত। ঘুষের বিরুদ্ধে নানা কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় মানুষের মাঝে এ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। এক সময় টেবিলের ওপর দিয়ে ঘুষ নেওয়া হতো। এখন হয়তো টেবিলের নিচ দিয়ে চলে। তবে টেবিলের ওপর দিয়ে নেওয়া বন্ধ হয়েছে। বড় বড় প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য চলে- এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্সেন্টেজ বাণিজ্য চলে। কমিশন বাণিজ্য মূলত ঘুষের বাণিজ্য। এই ঘুষ বন্ধ করতে সরকার তৎপর। দুদকও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ঘুষ দেওয়া ও নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেকের নাম পাচ্ছি। এই ঘুষের পেছনে কী আছে আমরা তা দেখছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে কিছু হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। কিছু হচ্ছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে, মানুষের ভেতরে লজ্জা-ভয় ঢুকছে। ঘুষটা আস্তে আস্তে কমবে। এ সময়ে দুদক নিজ উদ্যোগে কিছু করছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুদকের আলাদা ও স্বতন্ত্র উদ্যোগ নিশ্চয়ই আছে। কিছুদিন আগে অভিযুক্ত একজন সচিব এসেছিলেন দুদকে। তাকে তো সরকার ধরেনি। কয়েকদিন আগে একজন ব্যবসায়ী এসেছিলেন, সরকার তাকে ধরেনি। বরং তারা দুদকের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে বিচার চাইতে এসেছিলেন। আমরা আমাদের মতো কাজ করছি। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী চেষ্টা করছি। বিদ্যমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে প্রভাবশালীদের ধরা হবে কি না- জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান কমিশন একটি কাজ করেছে সেটা হলো প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি বন্ধ করেছে। অনেক প্রভাবশালীর ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দুদকের তালিকায় রাঘববোয়াল বা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নাম আছে কি-না এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। বর্তমান কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, কমিশন গত তিন বছরে একপা দু’পা করে এগিয়েছে। তবে জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আমরা এগোতে পারিনি। জনগণের যা প্রত্যাশা তার মধ্য থেকে কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। দুদককে মানুষ নখ-দাঁতহীন বাঘ দেখতে চায়নি। তাদের এই প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। অভিযুক্তদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। বিশাল দুর্নীতিগুলো খুঁড়ে খুঁড়ে বের করতে পারিনি। এটি কমিশনের ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে কমিশনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। কমিশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, আসুন আমরা সবাই মিলে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে যার যার জায়গা থেকে চেষ্টা করি। দুর্নীতি থাকে মানুষের মাথায়। এ ক্ষেত্রে মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। মনোভাব পরিবর্তন না করলে দুর্নীতি দূর হবে না। পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। এই কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলার কাজ করা হচ্ছে। এক সময় সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।