এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত শৈলকুপায় দুধসর ডিজিটাল স্কুলে সরকারী ভাবে ১২টি ল্যাপটপ টিআর কাবিখার অর্থ ৮৫ লাখ টাকার ভবনে দুর্নীতি আর অনিয়ম?
স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ: স্বামী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব আর স্ত্রী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক। এই ক্ষমতার জোরে মাত্র এক বছর আগে স্বামীর নিজের গ্রামে প্রতিষ্ঠিত একটি অখ্যাত স্কুলে সরকারী ভাবে ৮৫ লাখ টাকার ভবন বরাদ্দ পেয়েছে। পেয়েছে ১২টি ল্যাপটপ ও টিআর কাবিখার বেশুমার আর্থিক বরাদ্দ। অথচ একই গ্রামে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত আরেকটি স্কুলের কোন ভবন নেই। নেই সরকারী ভাবে কোন আর্থিক বরাদ্দ। অবৈধ প্রভাব আর ক্ষমতার জোরে রাতারাতি সরকারী সুবিধা পাওয়া স্কুলটি হলো ঝিনাইদহের শৈলকুপায় দুধসর ডিজিটাল স্কুল। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, শৈলকুপা উপজেলার দুধসর আব্দুস সোবহান জোয়ার্দ্দার নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। ১৮ বছর হয়েছে শিক্ষাবোর্ড তাদের পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে। আর একাডেমিক স্বীকৃতির বয়স ১৫ বছর। প্রতিষ্ঠানটি বাঁচিয়ে রাখতে শিক্ষাকরা বেতন ছাড়াই দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে দীর্ঘদিন পাঠদান করে অবশেষে এবার এমপিও ভুক্তির তালিকায় নাম লেকিয়েছে। তাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলও সন্তোষজনক। শুধু নেই সরকারি তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা। অথচ শিক্ষা অধিদপ্তরের বেশিরভাগ নিয়ম ভেঙ্গে মাত্র একবছর পূর্বে একই দুধসর গ্রামে আরেকটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যার নাম দুধসর ডিজিটাল স্কুল। চলতি বছর ২৮ মে যশোর শিক্ষা বোর্ড তাদের পাঠদানের অনুমতি দিয়েছেন। অল্প সময়ে তাদের ভাগ্যে চলে এসেছে ১২ টি ল্যাপটপ, আর নতুন ভবন নির্মানের জন্য পেয়েছেন ৮৫ লাখ টাকার বরাদ্ধ। এছাড়াও স্থানিয় টি.আর-কাবিখার সকল সুযোগ-সুবিধাও পেয়ে থাকেন তারা। অভিযোগ রয়েছে অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা হচ্ছে। দুধসর এলাকার সাধারণ মানুষ বলছেন, দুধসর ডিজিটাল স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি হচ্ছেন মোঃ মঞ্জুরুল হাফিজ। তিনি বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব হিসেবে কর্মরত। সভাপতি হিসেবে স্কুলের কাগজপত্রে যে সাক্ষর করেছেন, সেখানে তার নামের সঙ্গে মন্ত্রনালয়ের পদবীও ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী সেলিনা খাতুন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক। দুধসর আব্দুস সোবাহান জোয়ার্দ্দার নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুমারেশ চন্দ্র বিশ^াস অভিযোগ করেন মফস্বলে মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হলে কমপক্ষে ৩ কিলোমিটার দুরত্ব থাকার কথা থাকলেও দুধসর ডিজিটাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে একই গ্রামে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে। দুধসর ডিজিটাল স্কুলের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া কাগজপত্রে দক্ষিন, উত্তর, পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিনের চারটি বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা হলেও, পশ্চিমে নিজ গ্রামের আব্দুস সোবাহান জোয়ার্দ্দার নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথা গোপন করা হয়েছে। আর এই প্রত্যায়ন দিয়েছেন শৈলকুপার এলজিইডি’র উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ নাজমুল হুদা। এদিকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা এস.এম রফিকুল ইসলাম দুধসর ডিজিটাল স্কুলটি গত ১৩ মার্চ আকষিক পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন ফরমে ওইদিন বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী উপস্থিত দেখিয়েছেন ৬১ জন। আর বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১৫৫ জন উল্লেখ আছে। এছাড়া সরকার বর্তমানে এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দিলেও দুধসর ডিজিটাল স্কুলে সেই নিয়ম না মেনে স্থানিয় ভাবে ১১ জন শিক্ষক ও ৪ জন কর্মচারি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠদানের অনুমোদন চেয়ে করা আবেদনে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ স্কুলের জমির নামপত্তন হয়েছে। ২৫ মার্চ ভুমি কর প্রদান, একই দিনে বিদ্যালয়ের সংরক্ষিত তহবিলে ৫০ হাজার টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে গত ২৩ মে ২০১৯ পাঠদানের অনুমতি দেওয়া হয়। এরই মাত্র ৫ দিন পর যশোর শিক্ষা বোর্ড অনুমতিপত্র দিয়েছেন। আর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে টি.আর-কাবিখা প্রকল্প থেকে গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) প্রায় ১২ লাখ টাকা বরাদ্ধ পেয়েছেন। তারা মোট ৪০ মেঃ টন গম বরাদ্ধ পান। পরবর্তীতে খাদ্যগুদাম থেকে ২৭ মেঃ টন চার উত্তোলন করেন বলে শৈলকুপা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরো জানান, এই বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছিল মাঠের মাঠি ভরাট কাজে। দুধসর আব্দুস সোবহান জোয়ার্দ্দার নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুমারেশ চন্দ্র বিশ^াস জানান, এতো অনিয়ম করে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে এটা ভাবতে পারি না। দুধসর ডিজিটাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিজুর রহমান জানান, তারা বিদ্যালয় করছেন নিয়ম মেনেই। তাছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতি করতে নয়। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে তিনি বলেন, তারা বিধি মোতাবেক সবকিছু করছেন। নিয়মের বাইরে কিছুই হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন। আর ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোঃ মঞ্জুরুল হাফিজ জানান, তারা একটা ভালো স্কুল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। কাউকে ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই। তিনি বলেন, দুধসর ডিজিটাল স্কুলটি এমপিও ভুক্তির জন্য আবেদন করার সময় এখনও আসেনি। যারা পুরাতন স্কুল আছে তারা এমপিওভুক্ত হলে কারো আপত্তি নেই। তিনি বলেন, তাদের স্কুলটিতে ভালোভাবে পাঠদান হচ্ছে, স্কুলের পরিবেশও অনেক ভালো। আর যারা পুরাতন বলে দাবি করছেন তাদের প্রতিষ্ঠানের পড়ালেখার মান খুবই নিম্নমানের। অবকাঠামগত সমস্যাও রয়েছে। তিনি বলেন, এলাকার মানুষের জন্য অনেক কষ্ট করে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। স্কুলে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার বিষয়ে বলেন, তারা নিজেরাও অনেক জমি দিয়ে স্কুল করেছেন। আর সরকারি দপ্তরগুলোর কমকর্তারা তাদের এই কথা শুনে তারাও এগিয়ে এসেছেন। সে কারনে অল্পদিনে ভবন পেয়েছেন। এ বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামীম আহম্মেদ জানান, স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের কোনো কিছু করার থাকে না। স্থানিয়রা উদ্যোগ নিয়ে করে থাকেন। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। আর ঝিনাইদহ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার দেব বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কথা বলতে চাননি। তবে এক গ্রামে দুইটি স্কুলের বিষয়ে বলেন, এটাও বলা মুশকিল, এমনটি হবার কথা নয়। তবে শিক্ষা বিভাগের একটি সুত্র জানায়, স্বামী স্ত্রীর ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারী নিয়ম ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়েছেন।