ঘুষের টাকা পাশের বাসার ছাদে ফেলে দেন পার্থর স্ত্রী
ডেস্ক রিপোর্ট : সিলেট কারা কর্তৃপক্ষের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের ফ্ল্যাট থেকে ঘুষ-দুর্নীতির ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার দুপুরে গোপাল বণিককে গ্রেফতার করতে গেলে ওই টাকা ব্যাগে ভরে পাশের বাসার ছাদে ফেলে দেন তার স্ত্রী। পরে বিকালে ৮০ লাখ টাকাসহ তাকে (পার্থ) গ্রেফতার করা হয়। দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফ ও সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি টিম রোববার বিকালে পার্থ গোপাল বণিকের গ্রিন রোড সংলগ্ন ভূতের গলির বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করে। পার্থ বণিকের ফ্ল্যাটে দুদক অভিযান শুরু করে রোববার দুপুর ২টার দিকে। দুদক পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফ জানান, প্রায় ২ ঘণ্টা পার্থর স্ত্রী ডা. রতন মনি সাহা নানা টালবাহানা করেন। প্রথমে মুঠোফোনে বলেন, তিনি বাসায় নেই। মিরপুরে আছেন। সেখান থেকে ফিরতে ২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। অথচ সে সময় তিনি ফ্ল্যাটেই ছিলেন। দুদক টিম বিকল্প পন্থায় ফ্ল্যাটে প্রবেশের কথা বললে রতন মনি সাহা নিজেই দরজা খুলে দেন। তবে ততক্ষণে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে পার্থর আয় করা ৮০ লাখ টাকা ২টি ব্যাগে ভরে পাশের বাসার ছাদে ফেলে দেন তিনি। পরে দুদকের টিমের সদস্যরা তাকে নিয়েই ওই টাকা উদ্ধার করা হয়। এর পর পার্থ বণিকের ঘরের আলমিরা, তোশক, ওয়ারড্রোবসহ বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি করে লুকানো অবস্থায় ৮০ লাখ টাকা পায়। এই টাকা খুঁজে বের করতে কর্মকর্তাদের এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়েছে। টাকা উদ্ধারের পর তা গুনতে লেগেছে আরও এক ঘণ্টা। কিছু টাকা তিনি বালিশের কভারের ভেতরও রেখেছিলেন।
এর আগে রোববার সকালে চট্টগ্রাম কারাগারের দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে পার্থ দুদক টিমের কাছে বক্তব্য দিতে সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে হাজির হন।
অবৈধ সম্পদ, ঘুষের টাকা, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেয়া অর্থ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে গত বছর অক্টোবরে ঘুষের ৪৭ লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার চট্টগ্রামের জেলার সোহেল রানার দেয়া কিছু তথ্য সম্পর্কে তার কাছে জানতে চায় দুদক টিম।সোহেল রানা গ্রেফতারের পর বলেছিলেন, তিনি পার্থ গোপাল বণিককেও ঘুষের বেশ কয়েক লাখ টাকা দিয়েছেন। সেই সূত্র ধরে পার্থর কাছে দুদকের কর্মকর্তারা জানতে চান, আপনি ঘুষের এত টাকা কী করেছেন?দুদক কর্মকর্তারা সোহেল রানার দেয়া তথ্য ছাড়াও আরও কিছু প্রমাণ সামনে তুলে ধরে তার কাছে জবাব চান। এ সময় পার্থ নিজেকে আড়াল করে বক্তব্য দেয়ার চেষ্টা করেন। জেরার একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, রাজধানীর গ্রিন রোড সংলগ্ন তার নিজের ফ্ল্যাটে ৫০ লাখ টাকা রেখেছেন।বাসায় এত টাকা কেন রেখেছেন- এমন প্রশ্নে তিনি অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেন, এফডিআর করার জন্য রেখেছি। দুদক কর্মকর্তারা জানতে চান- এ টাকার উৎস কী? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পার্থ বণিক। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী দুদকের ওই অনুসন্ধান টিম তাকে নিয়ে রাজধানীর ২৭/২৮/১, নর্থ গ্রিন রোড (ভূতের গলি) তার ফ্ল্যাটে যায়।দুদকের অভিযান টিমের প্রধান পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ রাতে যুগান্তরকে বলেন, পার্থ বণিককে যখন আমরা দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম তখন তিনি একেক সময় একেক রকম তথ্য দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেন।আমাদের কাছে গোপন সূত্রে খবর ছিল, ডিআইজি পার্থ বণিক প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে কয়েক লাখ টাকা করে ঘুষ পান। তাকে তথ্য-প্রমাণসহ এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, আমার বাসায় নগদ ২০ লাখ টাকা আছে। পরে বলেন, ৩০ লাখ টাকা আছে। আমরা তার কথা বিশ্বাস করিনি।তাকে বলেছি, সত্যি করে বলেন, পরে তিনি বলেন, ৫০ লাখ টাকা আছে। কিন্তু আমরা সরাসরি তার ফ্ল্যাটে এসে ৮০ লাখ টাকা পেলাম। এই টাকা লুকানোর জন্য পার্থ বণিক ও তার স্ত্রী অনেক ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার বাসায় এত বিপুল পরিমাণ অর্থ রাখার ঘটনা নজিরবিহীন।তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার সহযোগী কর্মকর্তাদের নামও বের করা হবে। দুদক কর্মকর্তাদের ধারণা, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা এ অর্থ বাসায় রেখেছিলেন ডিআইজি প্রিজন পার্থ।ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক ২০০২ সালের ২০ জুন জেল সুপার হিসেবে যোগদান করেন। প্রথমে তার পোস্টিং হয় রংপুর। ২০১৪ সালে ডিআইজি (প্রিজন) হিসেবে পদোন্নতি পান। পরে তাকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাকে সিলেট বদলি করা হয়।২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতারের পর আলোচনায় আসেন ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক। ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত), ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক এবং ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ রেলওয়ে পুলিশ সোহেল রানাকে গ্রেফতার করে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন।চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলার সোহেল রানা গ্রেফতারের পর ‘ঘুষের ভাগ পার্থ বণিককে দিয়েছেন’- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিককে সিলেটে বদলি করা হয়। সোহেল রানার ঘুষের অর্থের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির খোঁজ পায় সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে কয়েক কর্মকর্তা একাধিকবার দুর্নীতির দায়ে বিভাগীয় শাস্তি ভোগ করেছেন- এ ধরনের তথ্যও বেরিয়ে আসে।সে সময় সোহেল রানার বিরুদ্ধে তদন্তের পাশাপাশি ডিআইজি পার্থ বণিকসহ বেশকিছু কারা কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দুদক থেকে ওই কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ ও ঘুষ-দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হয়।অনুসন্ধানকালে দুদক নানা মাধ্যম থেকে সোহেল রানা ছাড়াও অন্তত ৫০ কর্মকর্তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিমের কাছ থেকেও দুদক কিছু তথ্য পায়। তাতে কারা কর্তৃপক্ষের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের নাম রয়েছে বলে জানা যায়। এ ছাড়া দু’জন সিনিয়র জেল সুপার, ৭ জন ডেপুটি জেলারসহ ৪৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য দুদকের হাতে আসে।