নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটারি প্রকল্পে হরিলুট: এক কম্পিউটার দেড় লাখ, নলকূপে ২৫ লাখ টাকা
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেক্স: নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটারি সুবিধা দিতে পৌরসভার সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এবং রুপকল্প ২০২১ অর্জনে অবদান রাখার জন্য ৪০টি পৌরসভায় এই প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ১ জুন একনেক সভায় এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। একনেকের ওই সভায় জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন সেবা প্রাপ্তি সহজতর করার লক্ষ্যে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৩০ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নেই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ও স্থানীয় সরকার বিভাগকে এই প্রকল্প কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাড়ে তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও বাস্তবে প্রকল্পের বাস্তবিক অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের ৯৪% অতিবাহিত হলেও এখনো ৭০% কাজ বাস্তবায়ন করতে পারেনি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রকল্পের মালামাল কেনার নথিপত্র পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, এই প্রকল্পের প্রতিটি কাজেই অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয় ধরা হয়েছে, প্রকল্পটি মূল ব্যয় ২৩০ কোটি টাকা ধরা হলেও এতে কাজের ক্ষেত্রে পরামর্শদাতার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা অধিক। শুধু পরামর্শকই নয় প্রকল্পের হিসাবরক্ষণ নথিপত্র ও কাজের অগ্রগতির ডাটা সংগ্রহের জন্য ৮টি কম্পিউটার ক্রয় করা হয়েছে, যেটার হিসাব দেখানো হয়েছে ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। তাতে প্রতিটি কম্পিউটারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকা।
৪০ পৌরসভার ১৭ হাজার ২৩০টি বসতবাড়িতে পানির সংযোগ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৩৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এতে প্রতিটি ঘরে পানির সংযোগ দিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। অপরদিকে পৌরসভাতে ৭৮টি ডিপ টিউবওয়েল (উৎপাদক নলকুপ) স্থাপন বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, এতে প্রতিটি নলকুপ স্থাপন করতে খরচ হয়েছে ২৫ লক্ষ টাকা করে। ১৬১টি পানির পাম্প ও পাবলিক টয়লেট বিদ্যুৎ সংযোগ বাবদ খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা, এতে হিসাব করে দেখ যায় প্রতিটি টয়লেটে শুধু বিদ্যুৎ সংযোগেই খরচ করা হয়েছে ৮০ হাজার টাকার উপরে।
উক্ত প্রকল্পে শুধুমাত্র পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ খরা করা হয়েছে ৪০ লক্ষ টাকা। অন্যদিকে এই প্রকল্প শুরু করার আগে ১০০টি নলকুপ পরীক্ষা করার জন্য স্থাপন করা হয়েছে সেটার প্রতিটির খরচ ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এই প্রকল্পে অধীনে ৪০টি পৌরসভার ৬২০ কি.মি. পাইপলাইন স্থাপন করতে ৭৪ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। এতে প্রতি কি.মি. পাইপলাইন স্থাপনে খরচ হয়েছে গড়ে ১২ লক্ষ টাকা করে। ৬টি পানির ট্যাংক নির্মাণের খরচ দেখানো হয়েছে ৯ কোটি টাকা, এতে প্রতিটি প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। ৮৬টি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা, এতে প্রতিটির মুল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লক্ষাধিক টাকার ওপরে। প্রকল্পের নির্ধারিত ৪০টি পৌরসভায় পাকা ও আধাপাকা মোট ১১১টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। এতে প্রতিটি টয়লেট নির্মাণে খরচ হয়েছে ৮ লক্ষ টাকার ওপরে। কিছু কিছু পৌরসভায় টয়লেট নির্মাণ না করেও বরাদ্দের অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের চলাচলের জন্য ৫টি রানার মোটর সাইকেল কেনার জন্য খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৭ লক্ষাধিক টাকা। এমনকি ১টি জিপগাড়ি কেনা হয়েছে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা খরচ করে। উক্ত প্রকল্পটি দেখাশুনা করার জন্য কর্মী বাবদ খরচ হয়েছে ৭ লক্ষ টাকা। প্রকল্পের পানির পাম্পে ইলেকট্রিক বোর্ড স্থাপন করতে খরচ ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা, এত প্রতি বোর্ড স্থাপনেই খরচ হয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা।
এই প্রকল্পের নির্ধারিত ৪০ টি পৌরসভা হলো – মেহন্দিগঞ্জ, বোরহানউদ্দিন, স্বরুপকাঠি, শানারাশ, ছেঙ্গারচর, দাউদকান্দি, চকরিয়া, কবিরহাট, সাভার, ভাঙ্গা, কটিয়াদি, হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, মিরকাদিম, ত্রিশাল, পলাশ, ঘোড়াশাল, মনোহরদী, শিবপুর, নড়িয়া, ডামুডা, জাজিরা, ভেদোরগঞ্জ, নালিতাবাড়ি, নোয়াপাড়া, ঝিকরগাছি, কালিয়া, গুরুদাসপুর, সিংড়া, বেড়া, সাঁথিয়া, শাহজাদপুর, রতনপুর, ফুলবাড়ি, শেতাবগঞ্জ, বিরামপু, গাবতলি, শান্তাহার, মাধবপুর ও কালিগঞ্জ।এসব পৌরসভায় পানি ও স্যানিটেশনের জন্য বড় আকারের বরাদ্দ হলেও বাস্তবে বেশ কিছু পৌরসভায় এসব প্রকল্পের কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার যেখানে প্রকল্প খুঁজে পাওয়া গেছে সেখানে পাওয়া যায়নি একনেক থেকে অনুমোদিত প্যাকেজসমূহের কাজ। অর্থ বরাদ্দে প্রতিটি পৌরসভায় উৎপাদক নলকুপ, ওভারহেড ট্যাংক, পাইপলাইন, পানি শোধনাগার, পাবলিক টয়লেট, ঘরবাড়িতে পানির সংযোগের কথা উল্লেখ থাকলেও কিছু পৌরসভায় শুধু টিউবওয়েল ও পাবলিক টয়লেট স্থাপন করেই শতভাগ কাজ দেখানো হয়েছে।প্রকল্পের উদ্দেশ্য পুরণের লক্ষ্যে প্রকল্পের রাজস্ব ও মূলধন মোট ৩০ টি ক্যাটাগরি রেখে প্রকল্প ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। এসব প্রকল্পের প্রজেক্টের মধ্যে রয়েছে ভূ-গর্ভস্থ পানি শোধনাগার ৮টি, ওভারহেড ট্যাংক -৬টি, উৎপাদক নলকুপ-৭৪টি, পাইপ লাইন-৬২০ কি. মি, পানির গৃহসংযোগ-১৭২৩০টি, টিউবওয়েল-২১৬৫টি, পাবলিক টয়লেট-১১১টি। এই প্রকল্পের মূল বাস্তবায়নকাল ছিল জুন ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত মোট ৩ বছর ৬ মাস হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। পরে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পে সময় ১ বছর ৩ মাস বাড়ানো হলেও এখনো শেষ করতে পারেনি প্রকল্পের ৫০% কাজ। এই প্রকল্পের ব্যয় ১৮৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ২৩০ কোটি করা হয়।পানি সরবরাহ ব্যাবস্থা এবং স্যানিটেশন সুবিধা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসাবে এখানে পানি ও স্যানিটেশনের চাহিদাটাও একটু বেশি। সরকারের অন্যতম লক্ষ্য পৌরসভার পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং সেই লক্ষ্যে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন প্রকল্পটির বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সরকার।এই প্রকল্প বাস্তবিক অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পৌরসভার প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কমকর্তা জানান, আসলে আমাদের পৌরসভায় এই প্রকল্পের কাজ করার বরাদ্দ এবং নিদের্শনা আসার পরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তবে কি কি কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেটা আমার জানা নেই। তবে শুনেছি পানির লাইন, পাবলিক টয়লেট, গৃহসংযোগ, টিউবওয়েল নির্মাণ করার কথা রয়েছে কিন্তু ৪ বছরে শুধুমাত্র ২ পাবলিক টয়লেট আর বড়বড় নেতাদের বাসাবাড়িতে পানির সংযোগ ছাড়া তেমন কোন কাজ করা হয়নি।পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে এই আওতাধীন বরাদ্দকৃত পৌরসভা সাভার’র পৌর মেয়র হাজী মো. আবদুল গনি জানান, আমার পৌরসভায় পানির লাইনের কাজ ৭০% শেষ হয়েছে এবং বসতবাড়িতে পানির সংযোগও কিছুটা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ৫০ টি টিউবওয়েলের বরাদ্দ হয়েছে কিন্তু এখনো সেটার বাস্তবিক কোন কাজ শরু করা হয়নি। আশা করি দ্রুতই কাজ শুরু করা হবে।এ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ডিপিএইচ’র নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব বশির আহম্মেদ জানান, আমরা জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের বিধিবিধান মেনেই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করেছি ।এখানে উন্মুক্ত দরপত্র দিয়ে মালামাল কেনাসহ অন্যান্য কাজ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই করা হয়েছে।