মৃত্যুর কাছে হার মেনে চলে গেল অগ্নিদগ্ধ নুসরাত জাহান রাফি
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেক্স: মৃত্যুর কাছে হার মেনে অবশেষে চলেই গেলেন ফেনীর সোনাগাজীতে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার শিকার অগ্নিদগ্ধ মাদরাসাশিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি (১৮) (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। টানা ৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঢামেকের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন ব্রেকিংনিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ‘বুধবার সন্ধ্যার পর থেকেই নুসরাতের লাইফসাপোর্ট তেমন কাজ করছিল না।’
এরপর সামন্ত লাল সেন আইসিইউ থেকে রাতে বেরিয়ে ওই ছাত্রীর বাবা ও ভাইকে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরলে তারা বুঝতে পেরে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় পুরো বার্ন ইউনিটে স্তব্দ পরিবেশ তৈরি হয়। রাত সোয়া ১০টার দিকে সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নুসরাতকে বাঁচাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তবে ডিপ বার্ন হওয়ায় প্রথম থেকেই তা বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিলো। আজকেও সিঙ্গাপুরের ডক্টরদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিলো। কাল সকালে মরদেহের পোস্টমর্টেম হবে। আজকে লাশ হিমঘরে রাখা হবে।’ গেল শনিবার থেকে গত ৫ দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে নুসরাতকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার লাইফসাপোর্টে রেখেই প্রায় ২ ঘণ্টায় তার অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন চিকিৎসকরা। এর আগে শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হওয়ায় নুসরাত জাহানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠাতে ৮ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে তার শারীরিক অবস্থার কোনও উন্নতি না হওয়ায় তাকে দেশে রেখেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সিঙ্গাপুরের মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসরা। তবে ইতোমধ্যে নুসরাতকে সিঙ্গাপুরে নিতে সব ধরনের প্রস্তুতিই নেয়া হয়েছিল। অপেক্ষা ছিল শুধু শারীরিক অবস্থার একটু উন্নতি। এর আগে গত সোমবার ঢামেকের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানিয়েছিলেন, নুসরাতের শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। আর বুধবার সামন্ত লাল জানান, অস্ত্রোপচারের পর নুসরাত একটু আরাম পাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট কম হচ্ছে। তবে তার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত। নুসরাত এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মাওলানা এ কে এম মুসা মানিকের মেয়ে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। গত ২৭ মার্চ মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলা নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে নুসরাত বিষয়টি পরিবারকে জানায়। ওই দিনই তার মা সোনাগাজী থানায় সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মেয়েকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন। মামলার প্রেক্ষিতে ওইদিন দুপুরেই পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে। এরপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাত ও তার পরিবারকে চাপ দিতে থাকে অধ্যক্ষের লোকজন। কিন্তু তাতে অপারগতা প্রকাশ করায় গত ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আলিম পরীক্ষা চলাকালে মাদরাসা ভবনের ছাদে মুখোশধারী ৪ জন মিলে আগুনে ঝলসে দেয় নুসরাতের শরীর। পরে তাকে উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে থেকে গত শনিবার আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এর মধ্যে বোনকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় গত সোমবার (৮ এপ্রিল) অগ্নিদগ্ধ ওই শিক্ষার্থীর ভাই মাহমদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪ জন মহিলাসহ তাদের অন্য সহযোগীদেরও আসামি করা হয়।
এদিকে লাইফ সাপোর্টের যাওয়ার আগে গত রবিবার অগ্নিদগ্ধ ওই মাদরাসাছাত্রী চিকিৎসকদের কাছে জবানবন্দি দিয়ে বলেন, ‘নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পরিহিত চারজন আমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই চারজনের একজনের নাম শম্পা।’ গত মঙ্গলবার সকালে সেই শম্পাকে সোনাগাজীর মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে সোনাগাজী থানার পুলিশ বলছে, গ্রেফতার করা ওই নারীর নাম উম্মে সুলতানা ওরফে পপি।
এদিকে সোনাগাজী থানা-পুলিশের ওপর নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ ও আস্থাহীনতার প্রেক্ষিতে বুধবার সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এই মাদরাসাছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার মামলাটি হস্তান্তর করা হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই)। বুধবারই সোনাগাজী উপজেলা আমলি আদালতের বিচারক মো. শরাফউদ্দীন নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলায় প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে ৭ দিন রিমান্ডে পাঠিয়েছেন। একইসঙ্গে আদালত এ মামলায় গ্রেফতার মাদরাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক নূরুল আফসার উদ্দিন ও ছাত্র আরিফুল ইসলামকে ৫ দিন করে রিমান্ডে পাঠিয়েছে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত নুসরাতের এক সহপাঠীসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও মানববন্ধনের মুখে গত ৭ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মাদরাসাটি বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা ওই যৌন নিপীড়ক অধ্যক্ষের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন।