শিক্ষক সঙ্কটে মুখ থুবড়ে পড়ছে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম অপরদিকে জেলা শহরে শিক্ষকের ছড়াছড়ি

সাহিদুল এনাম পল্লব, ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি: উন্নত নাগরিক সুযোগ সুবিধা পেতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ শহরমুখী। ঝিনাইদহ সদরের গ্রাম্য এলাকার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো পড়েছে চরম শিক্ষক সংকটে। বিগ্নিত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা। জাতীয় শিক্ষা নীতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাম্য জনপদের কমলমতি শিক্ষার্থীরা। গ্রাম এলাকায় জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ব্যহত হচ্ছে শুধু শিক্ষক সংকটের কারনে। গ্রাম অপেক্ষা শহরের নাগরিক সুযোগ সুবিধা বেশি থাকায় গ্রামের মানুষ শহরমুখী। তাই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শহরের স্কুলগুলোতে বদলি হয়ে চলে আসছে। শহরের স্কুলগুলোতে পদ না থাকলেও ডেপুটেশনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে চলে আসছে শহরের স্কুলগুলোতে। এছাড়াও পিটি আই এর ট্রেনিং এবং মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি কারনে গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রায় শিক্ষক শুণ্য হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ স্কুলগুলোতে প্রধান শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শুণ্য পড়ে আছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে কোনমতে। যা দুই একজন আছে তারাও বদলি হতে না পেরে হতাশায় নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকমত পালন করছে না। ক্লাসে না পড়িয়ে ঐ একই ক্লাসের ছাত্র ছাত্রী দিয়ে অন্যান্য ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাস গ্রহণ করাচ্ছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ফুরসন্দি ইউনিয়নের ফুরসন্দি গ্রাম। এই গ্রাম থেকে বেশ দূরে ধঞ্জয়পুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। যার বর্তমান ছাত্র/ছাত্রী সংখ্যা প্রাথমিকে ২৭০ এবং মাধ্যমিকে ৯০ জন সহ মোট ৩৬০ জন। এই বিদ্যালয়টি সরকারের ২০১০ সালের শিক্ষানীতি মালা অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা পরিচালকের নির্দেশ অনুসারে ২০১৩ সালে ঝিনাইদহ জেলায় ৬টা উপজেলায় ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় কে অষ্টম শ্রেণী পযুন্ত পড়ানর নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশনায় বলা হয় যে এই বিদ্যালয় গুলিতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। জেলায় বাকি ৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শৈলকূপার কবিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হরিনাকুন্ডুর কাপাশাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালীগঞ্জের দামদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোটচাঁদপুরের লক্ষ্মীকুন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মহেশপুরের কুশাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফুরসন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রুহুল আমিন জানায় যে তার স্কুলে ৭ জন শিক্ষক একজন গেছে পিটিআই প্রশিক্ষণে একজন ডেপুটেশনে। এখন শিক্ষক মাত্র ৫ জন, শ্রেণী ৯ টা। সকাল থেকে শিশু শ্রেণী, প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী সহ ৫ ম শ্রেণীসহ ৪ শ্রেণীতে ক্লাস শুরু হয়। বেলা ১২ টার দিকে শিশু শ্রেণী সহ প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছুটি হয়ে গেলে আবার নতুন করে শুরু হয় ৩য়, ৪র্থ,৬ষট, ৭ম ও ৮ম শ্রেণী প্রযুন্ত শিক্ষা কার্যক্রম। তখন ৬ টি ক্লাসে শিক্ষক ৫ জন। তখন শিক্ষক অভাবে কোন না কোন ক্লাস বন্ধ থাকে। তাছাড়া এক টানা শিক্ষকেরা শিক্ষা কার্যক্রম চালান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদি কোন শিক্ষক অসুস্থ্য কিম্বা পারিবারিক কাজে ছুটি নেই তখন শিক্ষক অভাবে শিক্ষার কার্যক্রম বন্ধ না করে উপায় থাকে না। যার কারনে আমার এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল ভাল হচ্ছে না। ২০১৬ সাল পযুন্ত ৫ শ্রেণীতে মেধা তালিকায় প্রতি বছর বৃত্তি পেতে এখন পায় না। তাছাড়া এ বছর পিএসসি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করতে পারেনি। আমি আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কটের কথা উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে শুরু করে সর্ব মহল কে অবগত করে কোন লাভ হয়নি। ফুরসন্দি ইউনিয়নের আরেক স্কুল গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুর ১২.৩০ ঘটিকায় ১২০ নং মিয়াকুন্ড সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেয়ে দেখা গেলো শিক্ষকরা অফিসকক্ষে বসে আছে আর ক্লাসে পড়াচ্ছে একই ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীরা। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী আখি খাতুন তার সহপাঠিদের দুইটি ক্লাস নিয়েছে বাকি ক্লাসগুলোও সে নিবে বলে জানায়। সে প্রত্যেকদিনই এভাবে ক্লাস নেয় বলে জানায়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানায় এই বিদ্যালয়ে মোট ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ১৭৮জন। শিক্ষক আছে ৪জন তার মধ্যে দুই জন আছে পিটিআইতে অবশিষ্টি দুইজন শিক্ষক কিভাবে ৬টি ক্লাস পরিচালনা করবো। আমরা বারবার উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানাচ্ছি কিন্তু তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহন করে না। ঐ ইউনিয়নের ধনঞ্জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৩০ জন ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক ৫ জন। তারমধ্যে একজন পিটিআই প্রশিক্ষণে, ২ জন মাতৃকালীন ছূটিতে আর একজনে বাবা অসুস্থ্য তাকে নিয়ে ছূটিতে ঢাকায়। প্রধান শিক্ষক শিক্ষা অফিসে মিটিং এ। আজই দুই জনকে ডেপূটেশনে এসেছে। স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতির সাথে কথা হল সে বলল আমার স্কুলে ৩৩০ জন শিক্ষার্থী সেই হিসাবে শিক্ষক পাওনা ৯ জন শিক্ষক। শহরের স্কুল গুলিতে শিক্ষক গড়া গড়ি করে আর আমাদের স্কুলে শিক্ষক অভাবে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ডেপুটেশণ না এই স্কুলে পদ সৃষ্টি করতে হবে। পক্ষান্তরে ঝিনাইদহ জেলা শহর ও জেলা শহরে ও মহাসড়কের পাশের কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেল শিক্ষকের ছড়াছড়ি। যেমন বিষয়খালী স্কুলে শিক্ষার্থী ২১৬ জন শিক্ষক ১৩ জন। পিএসসি পরীক্ষায় জিপিও ৫ পেয়েছে ৬ জন, লাউদিয়াতে শিক্ষার্থী ১৩৩ জন শিক্ষক ৮ জন এবারে পিএসসি পরীক্ষায় ২৫ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ১ জন , হামদহ কাঞ্চন পুর স্কুলে শিক্ষার্থী ৩৩০ জন শিক্ষক ১৪ জন। পিএসসি পরীক্ষায় ৬২ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ৩২জন। আল হেরা স্কুলে শিক্ষার্থী ১৯০ জন শিক্ষক ৫ জন। পিএসসি পরীক্ষায় ২৬ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ২জন। ভুতিয়ার গাতি স্কুলে শিক্ষার্থী ২১০ জন শিক্ষক ১০ জন। পিএসসি পরীক্ষায় ২৩ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ৬ জন। কালিকা পুর স্কুলে শিক্ষার্থী ২০৮ জন শিক্ষক ৬ জন। পিএসসি পরীক্ষায় ৩৩ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ৫ জন। সেবাসংঘ স্কুলে শিক্ষার্থী ১৮৪ জন শিক্ষক ৯ জন। পিএসসি পরীক্ষায় ১৫ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ৫ জন। ঝিনাইদহ শহরের কেসি কলেজের পিছনে আদর্শ পাঠশালা স্কুলে শিক্ষার্থী ১৬৯ জন, শিক্ষক আছে ১০ জন। পিএসসি পরীক্ষায় ২৫ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ১ জন। আরাপ পুর মডেল স্কুলে শিক্ষার্থী ৪৭০ জন শিক্ষক আছে ১২ জন। পিএসসি পরীক্ষায় ৭৩ জন অংশ গ্রহণ করে জিপিও ৫ পেয়েছে ২০ জন। তাহাছাড়া ঝিনাইদহ মাগুরা সড়কে মাওলানা বাদ স্কুলে শিক্ষার্থী ১৯০ জন শিক্ষক আছে ১২ জন। ঝিনাইদহ শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সর্বনিন্ম ৫ জন শিক্ষক থাকতে হবে। তাছাড়া ৪০ জনে শিক্ষক একজন থাকার নিয়ম আছে। শহরের স্কুল গুলীতে অতিরিক্ত শিক্ষক থাকলেও গ্রামের স্কুল গুলীতে চরম শিক্ষক সংকট। এই প্রসঙ্গে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোস্তাক আহমেদের সাথে কথা বললে সে বলে যে ধনঞ্জয় পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই জন ডেপুটেশনে পাঠান হয়েছে। মিয়াকুন্ডুতে দুই জনকে পাঠানর জন্য কাগজ পত্র রেডি করা হয়েছে তারা অতি তাড়া তাড়ি ঐ স্কুলে যাবে। তাছাড়া ঝিনাইদহ শহরে অথবা তার আশে পাশে যে স্কুল গুলি আছে তা আমি যোগদানের পূর্ব থেকে। এই স্কুল গুলিতে যারা আছে তারা অধিকাংশ ঝিনাইদহ জেলা রাজনৈতিক ও অন্যদিক থেকে প্রভাবশালী হওয়ার কারনে তাদের অন্যত্র পাঠান সম্ভব না। ফুরসন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১০ সালের যে নীতিমালা অনুযায়ী ৮ম শ্রেণী পযুন্ত চালু করে হয়েছিল সেই কার্যক্রম মূলত স্থিড় হয়ে পড়েছে। তারপরেও আগের ডিপিও স্যার দুই জন কে ডেপূটেশনে পাঠিয়েছিল তারা সেখানে যায়নি। তাই আমার ঐ স্কুলের জন্য কিছু করা সম্ভব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *