ঝটিকা পরিদর্শনে গণশিক্ষা সচিব , চর ও দুর্গম অঞ্চলে শিক্ষার বেহাল দশা
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেক্স: দেশের চরাঞ্চল ও হাওরপ্রবণ দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা। এসব এলাকার ২০ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিনের পর দিন ক্লাস হয় না। ক্লাসের সময় অধিকাংশ বিদ্যালয় তালাবদ্ধ থাকে। কিছু বিদ্যালয়ে স্বল্প বেতনে ‘প্রক্সি শিক্ষক’ বা ‘প্যারা শিক্ষক’ দিয়ে ক্লাস করানো হয়। শিক্ষকরা মাসে দু-এক দিন বিদ্যালয়ে হাজির হয়ে হাজিরা খাতায় সই করে ঘণ্টাখানেক মধ্যে হাওয়া হয়ে যান। এ সব বিষয়ে খোঁজখবর রাখে না সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি (এসএমসি)। এমনকি এসব স্কুলে পরিদর্শনে যান না সংশ্লিষ্ট সহকারী উপজেলা অফিসার (এটিও), উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিও) বা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিও)। ফলে সরকারের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে বসেছে। শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে দুর্গম চরাঞ্চলের প্রায় ৩৬ লাখ শিশু-কিশোর। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন নিজ দফতরে বলেন, দেশের দুর্গম পাহাড়ি ও চরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস হয় না বলেই চলে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের বিদ্যালয়গুলো ‘হঠাৎ পরিদর্শন’র নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, ৬ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মার চরের সাতটি স্কুল পরিদর্শন করি।
সাতটির মধ্যে ছয়টিই বন্ধ পাই। ২৩ শিক্ষকের মধ্যে ২০ জন অনুপস্থিত ছিলেন। দুটি স্কুলে প্রকৃত শিক্ষকের বদলে ‘প্রক্সি শিক্ষক’ পেয়েছি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছে দিনের পর দিন স্কুলগুলো বন্ধ থাকে। পরিচালনা কমিটিও কোনো খোঁজখবর রাখে না। এসব দেখে তাজ্জব বনে গেছি। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে আকরাম আল হোসেন বলেন, অনুপস্থিত ২০ শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করে নতুন ২০ শিক্ষককে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। টিওকে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়, এটিওকে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে এবং ডিপিওকে ময়মনসিংহের ন্যাপে বদলি করা হয়েছে। সরকারি হিসাবমতে, দেশের চরাঞ্চল, হাওরপ্রবণ ও দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ২০ হাজার ৫২টি স্কুলে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৯ শিক্ষক রয়েছেন। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ লাখ ১৫ হাজার ৬৭০। সরকার মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণসহ উপবৃত্তি দেয়। এসব স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী শতভাগ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন অথচ বিদ্যালয়গুলোতে তাদের উপস্থিতি অতি নগণ্য। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু নজরদারি না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীরা বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত উপস্থিত না হয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে শিক্ষা অফিসার ও সহকারী শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি স্বাক্ষর করে নিচ্ছেন।
বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক অনিয়মিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা ও খোশগল্প করে বাড়ি ফিরছে। কোনো কোনো স্কুল দিনের পর দিন বন্ধ থাকছে। এতে করে চরাঞ্চলের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ভেস্তে যেতে বসেছে বলে ওই সব এলাকার অভিভাবকদের অভিযোগ। ঝটিকা পরিদর্শনে যা দেখলেন সচিব : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মার চরের সাতটি স্কুলে ঝটিকা পরিদর্শনে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকার বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইন্দু ভূষণ দেব। দুপুর ১২টায় তারা প্রথমে ৪২ নম্বর ডুবাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর ১৩ শিক্ষার্থীর দেখা মিললেও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহিদুর রহমান, সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার ও আবু তাহের মোল্লা কাউকে পাওয়া যায়নি। অষ্টম শ্রেণী পাস এক মেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা দেখভাল করছিল (বদলি শিক্ষক)। সচিবকে তিনি জানান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পাশের উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় গেছেন। এ সময় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের ১০ মিনিট ক্লাস নেন সচিব আকরাম। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীরা সচিবকে জানান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যাননি। তারা স্কুলে নিয়মিত আসেন না। ম্যাডামই তাদের ক্লাস নেন। কিছু অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- শিক্ষকরা মাঝেমধ্যে স্কুলে এলেও কিছুক্ষণ পর হাজিরা খাতায় সই করে চলে যান। এ সময় সচিব মোবাইল ফোনে হরিরামপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে শিক্ষকদের অনুপস্থিত থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকরা পাশের উচ্চ বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় যেতে পারেন। এসব তথ্য জেনে পাশের উচ্চ বিদ্যালয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে যান ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা। সেখানে গিয়ে মেলেনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এমনকি সেখানে ছিল না কোনো ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন। এরপর দুই কর্মকর্তা ৪১ নম্বর সুতালড়ী রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান। দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে স্কুলটি তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোখলেছিন আহম্মেদ, সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও প্রীতি চৌধুরী কেউই স্কুলে যাননি। স্কুলটির সামনের ছাদে মৌচাক দেখা যায়। সার্বিক পরিবেশ অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন। দেখলেই মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ক্লাস হয় না। স্থানীয় অভিভাবকরা জানান, মাঝে-মধ্যে শিক্ষকরা অদল-বদল করে আসেন। অর্থাৎ একজন এলে অপর দু’জন আসেন না। দুপুর দেড়টায় দুই কর্মকর্তা ৫৭ নম্বর হারুকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান। সেখানেও স্কুলটি ছিল তালাবদ্ধ। সার্বিক পরিবেশ অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মনি মিয়া, সহকারী শিক্ষক আবদুর রহিম, পলাশ তালুকদার ও ইসরাফিল হোসেন কেউই স্কুলে যাননি।
স্থানীয় লোকজন সচিবকে জানান, শিক্ষকরা স্কুলে নিয়মিত আসেন না। মাঝে-মধ্যে এলেও অনেক ক্ষেত্রে পালাবদল করে আসেন। তাদের এমন কার্মকাণ্ডে শিশুরা শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা এরপর ৮৫ নম্বর এনায়েতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান। সেখানে দেখা মেলেনি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আরমান আলী, সহকারী শিক্ষক নুরুন্নাহার আক্তার ও মিজানুর রহমানসহ কোনো শিক্ষার্থীর। দেখা যায়, নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। পাশের ছোট টিন শেডে কয়েকটি বেঞ্চ পাওয়া গেলেও ব্ল্যাকবোর্ড/পাঠদানের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। উপস্থিত একজন শিক্ষার্থী জানান, স্যাররা নিয়মিত স্কুলে আসেন না। মাঝেমধ্যে আসলেও ২ ঘণ্টা অবস্থান করে আবার খেয়া নৌকায় চলে যান। ৪৪ নম্বর আজিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই অবস্থা পাওয়া যায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন না স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্মৃতি চৌধুরী, সহকারী শিক্ষক নাজমুল হক ও গোবিন্দ্র চন্দ্র বাড়ৈ এবং কোনো শিক্ষার্থী। তবে স্কুলের দফতরি কাম নৈশপ্রহরীকে স্কুল মাঠে পাওয়া যায়। খবর পেয়ে সহকারী শিক্ষক গোবিন্দ্র চন্দ্র বাড়ৈ উপস্থিত হয়ে মিথ্যা তথ্য দেন। তার ড্রেস ও আচরণ শিক্ষকসুলভ ছিল না। স্কুলের সার্বিক পরিবেশ ছিল চোখে পড়ার মতো অপরিষ্কার ও নোংরা। বেলা ৩টায় ৩৯ নম্বর সুতালড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন সচিব আকরাম। স্কুলটি খোলা হলেও দুপুর ২টার আগেই ছুটি হয়ে যায়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাহমুদা ফারজানা খবর পেয়ে স্কুলের আশপাশ থেকে কিছু শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে শ্রেণীকক্ষে বসান। একই কক্ষে একাধিক শ্রেণীর শিক্ষার্থী উপস্থিত পাওয়া যায়। শিক্ষিকা কিছু মিথ্যা তথ্য দেন। কিন্তু সহকারী শিক্ষক তারিন আক্তার ও ছোবুরা আক্তারকে স্কুলে পাওয়া যায়নি। এরপর বেলা ৩টা ১৮ মিনিটে তারা ৩০ নম্বর হরিণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান। স্কুলটিও নির্ধারিত সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে যায়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে এলাকার শিক্ষার্থী ডেকে নিয়ে স্কুলে যান প্রধান শিক্ষক শুভ্র সাহা। একই কক্ষে একাধিক শ্রেণীর শিক্ষার্থী উপস্থিত পাওয়া যায়। রওশন আরা নামে এক মহিলাকে স্কুলে পাওয়া যায়। প্রথমে তিনি নিজেকে শিক্ষিকা হিসেবে দাবি করলেও জেরার মুখে জানান, প্রতি মাসে তাকে আড়াই হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। স্কুলের পাঁচজন শিক্ষক ৫০০ টাকা করে দেন। প্যারা শিক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করেন। সহকারী শিক্ষক লোকমান হোসেন ও রোজিনা খানম ইতিকে অনুপস্থিত পাওয়া যায়। অপর সহকারী শিক্ষক সীমা রানী সিংহ নৈমিত্তিক ছুটি এবং ফেরদৌসী আক্তার চিকিৎসা ছুটিতে রয়েছেন বলে জানানো হয়।