কক্সবাজারে ২৯ গডফাদারসহ ১০২ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ
মোঃ নিজাম উদ্দিন, কক্সবাজার: অপরাধ স্বীকার এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পেতে ৯ শর্ত মেনে নিয়ে শনিবার কক্সবাজারের টেকনাফে ২৯ শীর্ষসহ ১০২ ইয়াবা চোরাকারবারি ৩০ আগ্নেয়াস্ত্র, ৭০ রাউন্ড গুলি এবং সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবাসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক ও বিজিবির স্থানীয় উর্ধতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করেছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে এখনও ১০৪৯ ইয়াবা কারবারি গা ঢাকা দিয়ে আছে। পালিয়ে আছে ইয়াবার সঙ্গে জড়িত হুণ্ডি ব্যবসায়ীরাও। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনুষ্ঠানস্থল ছিল লোকে লোকারণ্য। অসংখ্য গণমাধ্যম কর্মীর উপস্থিতিও ছিল। তবে উখিয়া-টেকনাফজুড়ে সৃষ্টি হয়ে আছে এক ধরনের আতঙ্ক। এ আতঙ্কের মূল কারণ হচ্ছে আত্মসমর্পণের এ অনুষ্ঠানের পর ইয়াবা চোরাকারবারিদের নিয়ে কি হতে যাচ্ছে। কেননা তালিকাভুক্ত ১০৪৯ ইয়াবা কারবারি এখনও গা ঢাকা দিয়ে আছে। সরকার পক্ষে আবারও এদের বিরুদ্ধে কড়া সতর্ক বার্তা প্রদান করা হয়েছে। আত্মসমর্পণকৃতদের মধ্যে ২৯ জন গডফাদার হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং অপর ৭৩ জন সরাসরি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আত্মসমর্পণের পর এই ১০২ ইয়াবা চোরাকারবারিকে মাদক ও অস্ত্র আইনে আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এসব চোরকারবারিদের জন্য টেকনাফে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আদালত স্থাপন করা হয়। পুলিশের পক্ষে আত্মসমর্পণকৃতদের নামের তালিকা ও তাদের পক্ষ থেকে অস্ত্র ও ইয়াবার চালান হস্তান্তরের পর তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রুজু হয়। এরপর এদের সকলকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সংশ্লিষ্ট আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেলোয়ার হোসেন। আত্মসমর্পণের আগে এদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগের হাতছানিতে এসব ইয়াবা কারবারিরাও ছিল উচ্ছ্বসিত। তবে অজানা শঙ্কাও যে তাদের মধ্যে নেই তা বলা যাবে না। এরপরও এরা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে মরণনেশা মাদক ব্যবসা ছেড়ে আত্মসমর্পণের সুযোগ পেয়েছে। এর আগে গত এক বছরে এদের দলের ৬০ জন বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। মূলত বিভিন্ন সংস্থার সাঁড়াশি অভিযানে এরা টিকে থাকার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। এ বিষয়টিই তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে এবং আত্মসমর্পণে সুযোগ দানের প্রক্রিয়াটিকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা। গত কয়েকদিন ধরে টেকনাফে শতাধিক ইয়াবা চোরাকারবারি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে এমন সংবাদ ছড়িয়ে হওয়ার পর উৎসুক সকলের দৃষ্টি চলে যায় সেদিকে। শনিবার বেলা ১১টা থেকে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে তৈরিকৃত বিরাট মঞ্চে উক্ত ১০২ ইয়াবা কারবারি তাদের পক্ষ থেকে একে একে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ইয়াবার চালান সমর্পণ করে আত্মসমর্পণ করে। অস্ত্রের মধ্যে ৩০টিই দেশীয় পিস্তল। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে কক্সবাজারের তিন সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল, শাহীন আক্তার ও জাফর আলম, জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ ইকবাল হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্য উপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার যান আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী। এরপর শুক্রবার পৌছেন স্বরাস্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে নানা জল্পনা কল্পনা এবং নানা বক্তব্য চাউর হয়ে যায়। কেননা এ ধরনের অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণের পর ইয়াবা চোরাচালানিদের পরিণাম কি হচ্ছে তাই নিয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নাম উঠেছে ১১৫১। এর বাইরে রয়েছে আরও প্রায় ৩০ জন হুন্ডি ব্যবসায়ী। এদের অধিকাংশ দেশের বাইরে অবস্থান করছে। মূলত মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসার পর এর মূল্য পরিশোধ হয় হুন্ডির মাধ্যমে। দুবাই, সিঙ্গাপুর হয়ে মিয়ানমারে ইয়াবা উৎপাদনকারীদের কাছে হুন্ডি পথে অর্থ পাঠিয়ে দেয় হুন্ডি সম্রাটরা। শনিবারের অনুষ্ঠানে এদের কেউ আত্মসমর্পণ করেনি। এ হুন্ডি ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় হলেন টিটি জাফর নামে একজন। শনিবার যারা আত্মসমর্পণ করেছেন এদের অধিকাংশ টেকনাফের বাসিন্দা। এদের অপকর্মের বিরুদ্ধে পুলিশ ছাড়াও সিআইডি, দুদক এবং এনবিআরকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া আছে। শনিবার টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হওয়ার আগে পুলিশ হেফাজতে থাকা এই ১০২ ইয়াবা চোরাচালানিকে কক্সবাজার পুলিশ লাইন থেকে বাসযোগে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসা হয়। এরপর একে একে বাস থেকে তাদের নামিয়ে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পক্ষে বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি আত্মসমর্পণকৃতদের মধ্যে থেকে ২ জনকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হয়। এরা তাদের বক্তব্যে তাদের অতীত অপকর্মের জন্য সরকারের কাছে প্রাণভিক্ষা কামনা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দানের জন্য আকুতি জানায়। অনুষ্ঠান শেষে টেকনাফ মাঠে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী আদালতে এদের সকলের নাম এবং জমা দেয়া অস্ত্র ও ইয়াবার চালানের নমুনা উপস্থাপন করে পুলিশের এদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রুজুর বিষয়টি উপস্থাপন করে। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেলোয়ার হোসেন পুলিশের বক্তব্য শোনার পর এদের সকলকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশনা প্রদান করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, আত্মসমর্পণকৃতদের জন্য কেউ জামিন প্রার্থনা করেননি। এরপর পুনরায় বাসযোগে এদের সকলকে কক্সবাজার জেলা কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সূত্রে জানা গেছে, আত্মসমর্পণের আগে সরকার পক্ষে এদের ৯টি শর্ত দেয়া হয়েছে। এসব শর্ত মেনে নেয়ার শর্তেই তারা আত্মসমর্পণের সুযোগ পেয়েছে। প্রদত্ত শর্তের মধ্যে রয়েছে নিজের হেফাজতে থাকা সকল ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা, আত্মসমর্পণের আগে দায়ের হওয়া তাদের বিরুদ্ধে মামলাও বিচার কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মে চলার বিষয়টি মেনে নেয়া, ইয়াবা ব্যবসায় তাদের নিজ নিজ পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়স্বজনের নামে বেনামে অর্জিত সকল সম্পদ দুদক এবং সিআইডির মানিলন্ডারিং শাখা ও এনবিআরের মাধ্যমে যাচাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি মেনে নেয়া, আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় দায়ের হওয়া মামলায় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সহায়তা প্রদানের বিষয়টি মেনে নেয়া, যে সকল মাদক ব্যবসায়ী এখনও সক্রিয় রয়েছে তাদের ব্যাপারে সোর্স হিসেবে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা, আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্তি ঘটলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকায় মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা, ভবিষ্যতে কখনও মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত না হওয়া ইত্যাদি। আত্মসমর্পণের এ অনুষ্ঠানে সরকারী বিভিন্ন সংস্থার তালিকাভুক্ত কিছু ইয়াবা কারবারিকেও উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। দর্শক সারির দ্বিতীয় লাইনে চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখা গেছে তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলমকে। আগে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। কয়েক বছর আগে বিএনপি ছেড়ে তিনি সরকারী দলে যোগদান করেছেন। তার পাশাপাশি আরও কয়েক ইয়াবা কারবারিকে দর্শক সারিতে দেখা গেছে।