ঝিনাইদহে মানব পাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়ে প্রায় ৬ বছর ধরে নিখোঁজ ১৯ যুবকের খোঁজ আজও মেলেনি

সাহিদুল এনাম পল্লব, ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি: ” আখার আগুন নেভে বাবা বুকের আগুন নেভে না” এই কথাটি বললেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হালিধানি ইউনিয়নের রামচন্দ্র পুর গ্রামের হাজরা বেগম। আজ থেকে প্রায় ৬ বছর আগে তার বুকের মানিক আব্দুল হামিদ বাড়ির কাউকে কিছু না বলে হটাৎ উধাও হয়ে যায়। উধাও হওয়ার প্রায় ১৪/১৫ দিন পরে একটি অচেনা নাম্বর থেকে ফোনের মাধ্যমে জানায় যে আমি টেকনাফে জাহাজে উঠছি মালেয়েশিয়া যাচ্ছি। তারপর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। জানি না আমার বুকের মানিক বেঁচে আছে না মরে গেছে। এই ভাবেই রামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকে ৬ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে গেছে আব্দুল্লার ছেলে আব্দুল হামিদ, মৃত তোফাজ্জেলের ছেলে লাবলু রহমান জিতু ও আবুল কাসেমের ছেলে আরাফাত। রামচন্দপুর গ্রামের নিখোঁজ হামিদের স্ত্রী লিপি জানায় যে আমার কোলের মেয়ে জামিলার বয়স তখন ১ বছর তখন আমার স্বামী বিকালে হলিধানি বাজারে যাওয়ার নাম করে বের হয়, আর ফিরে আসে না। তার প্রায় ১৪/১৫ দিন পর একটি অচেনা নাম্বর থেকে মোবাইলের মাধ্যমে জানায় যে আমি মালায়েশিয়া চলে যাচ্ছি, জাহাজে উঠেছি পরে কথা হবে মালায়েশিয়া গেলে টাকা দিতে হবে। এই বলে মোবাইল কেটে দেয়। তারপর আর কিছুই জানতে পারিনি যে সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। আমার ছোট মেয়ে জামিলার বর্তমান বয়স ৬ বছর। হামিদের ৩ মেয়ে বাবা কবে ফিরে আসবে সেই পথ চেয়ে বসে আছে। কথা হয় একই গ্রামের নিখোঁজ লাবলু ও আরাফাতের স্ত্রীর সাথে। জানা যায় লাবলুর বাবা ছেলে নিখোঁজের শোক সহ্য করতে না পেরে হার্ড অ্যাটাক করে প্রায় ২ বছর হল মারা গেছে। তার ২ মেয়ে। পাশের বাড়ির আরাফাতের স্ত্রী হালিমা জানায় তার ৩ মেয়ে সেও একই ভাবে চলে যায়। মেয়েরা শুধু তার বাবার ছবি চেয়ে চেয়ে দেখে। সে আরও জানায় ” পানি পথে জাহাজে যাওয়ার পথে জাহাজে তার স্বামী অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে জাহাজ থেকে পানিতে ফেলে দেয়” এই কথা মালায়েশিয়া থেকে বাহার আলী নামের এক ব্যক্তি ফোন করে জানায়। আরাফাতের বাড়ির পাশেই মালায়েশিয়া পানি পথে যেয়ে বেঁচে ফিরে আসা মতিন নামে একজনের সাথে কথা হয়। মতিন জানায় এক নির্মম কাহিনি । তার মধ্যে সে উল্লেখ করে বলে যে যাওয়ার সময় দালালেরা জাহাজে উঠায় সেখানে ঠিক মত খাবার থাকে না। পথে অনেকে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে জীবিত পেট ফেড়ে সাগরে ফেলে দেয়। আবার কাউকে কাউকে থাইল্যান্ডের জংলে পুতে রাখে। রামচন্দপুর গ্রাম থেকেই জানা যায় যে পাশের গাড়ামারা গ্রামের আজও নিখোঁজ আছে ৮ জন। তারা হল- গ্রামের গোলাম রসূলের ছেলে রিপণ, গোলাম মোস্তফা দুলালের ছেলে ফরিদ হোসেন, ইদ্রিস আলির ছেলে আবু বকর, শহর আলির ছেলে নাজমুল হক, নাছির উদ্দিনের ছেলে লালচাঁদ, বসির উদ্দিনের ছেলে মাসুদ রানা মচু, শাহী উদ্দিনের ছেলে আলমগীর ও লুৎফর রহমানের ছেলে অলিয়ার রহমান। রিপনের মা জানায় ছেলে বউ নিয়ে ঢাকায় থাকত রাজমিন্ত্রির কাজ করত একদিন হটাত ফোন করে বলে যে মা আমি জাহাজে চড়ে মালায়েশিয়া যাচ্ছি তার পর আবার ১০/১২ দিন পরে ফোন দিয়ে বলে যে আমি টলায়ে উঠছি। এই টার শেষ সংবাদ তারপর আর কি হয়েছে বলতে পারব না। রিপণ চলে যাওয়ার পর বউ একদিন এসেছিল তার একটি ছেলে আছে। বউ আবার অন্য জাইগা বিয়ে করেছে। রিপনের পাশের বাড়ী ফরিদের বাড়িতে যাওয়ার পথে ফরিদের মায়ের সাথে দেখা হলে সে জানতে চাইল আমার ফরিদের কোন খবর আছে? ফরিদ কি ফিরে আসবে ? বাড়িতে ফরিদের স্ত্রী জানায় মালায়েশিয়া যাওয়ার জন্য হলিধানি মনোয়ার নামের এক ব্যাক্তির নিকট ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা দেয়। সেই টাকা মনোয়ার ফেরত দেয় না । এই টাকা মার খেয়ে কালীগঞ্জের সালাম নামে এক ব্যক্তি ঝিনাইদহের পবহাটি বিয়ে করেছে তার মাধ্যমে আমাদের গ্রামের ছেলে আতিয়ার পাঠায়ে দেয়। আজও তার বাড়ির কেউ জানতে পারেনি যে সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। তাছাড়া মধুহাটি ইউনিয়নের মহামায়া গ্রামের জনৈক জালাল উদ্দিন মলয়েশিয়ার যাবার পর দীর্ঘদিন নিখোঁজ রয়েছে। গাড়ামারা গ্রামের সকলের সাথে কথা বলে জানা যায় যে তাদের মালায়েশিয়া পাঠানর মুল হোতা হল লুৎফর রহমানের ছেলে আতিয়ার। দালাল আতিয়ারের নামে মামলা করা হয়েছিল। পুলিশ আতিয়ারকে আটক করেছিল। কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি ছেলেদের। আতিয়ার কিছু দিন জেল হাজতে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়ে এসে মলয়েশিয়ায় চলে গেছে। এই ৮ জনের মধ্যে আতিয়ারের নিজের ভাই ওলিয়ার নিখোঁজ রয়েছে। তবে এই পরিবার গুলির কেউ স্থানীয় থানায় কার নামে কোন অভিযোগ করেনি। এ ছাড়া প্রায় ৬ বছর নিখোঁজ ফুরসুন্দি ইউনিয়নের মিয়াকুন্ডু গ্রামের ৪ জন তারা হল সাহেব আলী মণ্ডলের ছেলে ইউনুছ, জলিল জোরদারের ছেলে বাচ্ছু, ময়েন উদ্দিন জোয়াদ্দারের ছেলে বিপুল জোয়াদ্দার, আতিয়ার রহমান বিশ্বাসের ছেলে ওলিয়ার রহমান। ঘোড়শাল ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামের ৩ জন। তার মধ্যে বিশারত মণ্ডলের দুই ছেলে তারিক মণ্ডল ও উলফাত মণ্ডল এবং বিসারত মণ্ডলের ভাগ্নে দিপু বিশ্বাসের ছেলে শহিদুল ইসলাম। এই ৭ জনের শুধু বিপুল জোয়াদ্দার বাদে বাকি জনদের তেতুলবাড়িয়া গ্রামের শামছুদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে সাবুর আলী বিশ্বাসের মাধ্যমে ঝিনাইদহের পবোহাটি গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে আফাঙ্গির নিয়ে যায়। শুধু তাই না যখন এদের স্বজনরা এদের খোঁজ না পেয়ে উতাল হয়ে পড়ে তখন এদের পরিবারের সামনে এক কাল্পনিক গল্প হাজির করে বলে যে তারা মায়ারমারের আইক্যাব জেলে আটকা আছে সেখান থেকে বের করতে মাথা পিছু ৫০ হাজার করে টাকা লাগবে। এই বলে সাবের আলী ও আফঙ্গির প্রতেকের পরিবারের নিকট থেকে ৫০ হাজার করে টাকা নেই। যাহা গ্রামবাসী অবগত আছে। এই সময়ে জলিল জোয়াদ্দার ও বিশারত মণ্ডল ঝিনাইদহ থানা ও র‌্যাব অফিসে অনেক ঘুরাঘুরির পর ও এই মানব পাচারকারিরা শক্তিশালী হওয়ার কারনে তাদের কোন শাস্তি হয়নি এবং তাদের টাকাও ফেরত পায়নি। পরিবারের সাথে কোন যোগযোগ নেই বলে শুধু এই ১৯ জন নয় পুরা ঝিনাইদহ জেলা জুড়ে আরও অনেকে মালায়েশিয়া পানি পথে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে তার পরিবারের আপন জনের চোখের পানি শুখায়ে গেছে। তবে এবিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.মিজানুর রহমান খান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন বলে তিনি জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *