ভোটের মাঠে সেনাবাহিনী তো নেমেছে, কতটুকু পাল্টেছে নির্বাচন পরিস্থিতি ?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ঐক্যফ্রন্ট-বিএনপি তথা বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের দাবির মুখে অবশেষে ভোটের মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। গত রবিবার (২৩ ডিসেম্বর) রাত ১২টার পর থেকে সারা দেশে সেনাবাহিনী নামতে শুরু করে।বলা হয়েছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বেই সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। এরইমধ্যে সেনা মোতায়েনের প্রায় দু’দিন পেরিয়ে গেলেও বাস্তবে ভোটের মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ কিংবা বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, দমন-পীড়ণে দৃশ্যমান কোনও পরিবর্তন দেখছেন না দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।এ নিয়ে বিবিসি বাংলায় একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সেনা মোতায়েনের পর গত দুদিনে নির্বাচনী পরিবেশে কোনও পরিবর্তন এসেছে কিনা কিংবা সেনাদের ভূমিকার ধরন কী হবে সে বিষয়গুলোই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ৬ দিন আগে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। যারা কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে’।সোমবার প্রথম দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনীর টিম রাস্তায় টহল দিয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে ৩৮৯টি উপজেলায় এবং নৌবাহিনী কাজ করছে মোট ১৮টি উপজেলায়।নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু থেকেই বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ, সহিংস হামলা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে চলেছে। বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নির্বাচনী প্রচারণায সহিংস হামলার অভিযোগ করে আসছে।গত কয়েকদিন সবচেয়ে বেশি হামলা বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায়।সশস্ত্র বাহিনী মাঠে নামার পর পরিস্থিতির কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? নোয়াখালীর শহরতলী থেকে কয়েকজন ভোটার বলছিলেন, সংঘর্ষ-সহিংসতার আতংকের পর সেনাবাহিনী মাঠে নামায় তাদের ভয় কিছুটা কমেছে।স্থানীয় এক গৃহিণী মোছাম্মদ জনি বলেন, ‘এতদিন তো ভয়ে থাকতাম। বোমা মারে, সংঘর্ষ হয়। এখন তো সেনাবাহিনী নামছে। আমাদের ভয় একটু কমেছে।’নোয়াখালীর শহরতলী থেকে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো: ইদ্রিস বলছিলেন, ‘এখানে নির্বাচনী প্রচারণায় আগে উত্তেজনা ছিল। এখন সেনাবাহিনী নামায় পরিস্থিতি শান্ত আছে।’প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলছেন, ‘সেনাবাহিনী মাঠে নামায় ভোটারদের মাঝে আস্থা ফিরে আসবে। সেনাবাহিনী মোতায়েনের উদ্দেশ্যই হলো, ভোটারদের আস্থা আসবে। এই সুযোগে আমি সব রাজনৈতিক দলের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করি, নির্বাচন যেন নির্বাচনের মতো হয়, সহিংসতা, নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, তর্কবিতর্ক, হাঙ্গামা – এগুলো পরিহার করে, কেবলমাত্র তারা যেন নির্বাচনী কর্মকান্ডে মনোযোগ দেন।’প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী যেকোনও দায়িত্ব পালন করবে এবং তাদের সামনে কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তারা নিজ উদ্যোগে সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে।’মতলব উত্তর এবং দক্ষিণ উপজেলা নিয়ে চাঁদপুর-২ আসনে বিরোধীদল বিএনপি প্রার্থী ড: জালালউদ্দিন অভিযোগ করেছেন, প্রচারণার শুরু থেকে তিনি কার্যত গৃহবন্দি হয়ে আছেন। তার কর্মীদের প্রচারণায় বাধা দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একতরফা প্রচারণা চালাচ্ছে।তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী মাঠে নামার পরও তার এলাকায় পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। গত ১০ দিন যাবত পুলিশ আমাকে নিরাপত্তার নামে গৃহবন্দি করে রেখেছে। আমার কোন কর্মী আসতে পারে না। আসলেই তারা গ্রেফতার করে। আর সেনাবাহিনী নেমেছে শুনেছি। কিন্তু এই এলাকায় উত্তেজনা থাকলেও আর্মি দেখিনি।’এই চাঁদপুর-২ আসনে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী নুরুল আমীন রুহুল একতরফা প্রচারণা অব্যাহত রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা যার অবস্থান থেকে প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। এখানে সুন্দর পরিবেশে প্রচারণা চলছে।’সেনাবাহিনী নামার পরও বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কয়েকটি জায়গায় তাদের প্রচারণায় হামলার অভিযোগ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ তা অস্বীকার করেছে। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে প্রধান দুই দলই বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেছে।বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেছেন, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে বলে তারা আশা করেন। মঙ্গলবার (২৫ ডিসেম্বর) সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘গতকাল ছিল সবচেয়ে ভায়োলেন্ট দিন। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের টেক্কা দিয়ে পুলিশই সন্ত্রাসী আক্রমণে প্রাধান্যে থেকেছে। দেশের বিভিন্ন ধানের ধানের শীষের প্রার্থীদের প্রচারণা ও সমাবেশে সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে গতকাল। আমরা ভেবেছিলাম সেনাবাহিনী নামার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে সেটি হয়নি, তবে আমরা এখনও আশাবাদী।’অন্যদিকে আওয়ামী লীগে নেতারা বলেছেন, সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে কারও উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। তারা উল্লেখ করেছেন, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে।গতকাল সোমবার (২৪ ডিসেম্বর) ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলা সদরের আতাতুর্ক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী নামায় এত উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। মনে রাখুন, তারা কোনও দল বা পক্ষের নয়। সেনাবাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা বিতর্কিত হয়- আশা করি কেউ এমন বক্তব্য দেবেন না।’ বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্যে কাদের বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থাকে বিতর্কিত করেছেন। এবার সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করবেন না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *