আজ ভয়াল সিডরের ১১ বছর পরও আতঙ্কে উপকূলবাসী


এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট.বাগেরহাট:দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষের জন্য এক ভয়াল দিন। আজ ভয়াল সিডরের ১১ বছর পরও পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নির্মিত না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে উপকূলীয় এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। সিডর তাণ্ডবের ভয়াল ১৫ নভেম্বর ২০০৭ সালের ওই রাতে । জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চল লন্ড-ভন্ড করে দিয়েছিল। ১১ বছর পরে প্রকৃতির সেই রুদ্র রোশের ভয়ালচিত্র স্মরণ করে গোটা উপকূলবাসী এখনো আঁতকে ওঠেন। ঝড়ের তীব্রতা কমে যাওয়ার পর শুরু হয় স্বজনদের খোজাখুজি। কারও বাবা নেই, কারও মা নেই। আবার কারও নেই স্ত্রী, পুত্র কন্যা, ভাই-বোন , দাদা-দাদী, নানা-নানী, মামা-মামী, খালা-খালু, চাচা-চাচি, গাছের ডালে কিংবা বাড়ি ঘরের খুটির সঙ্গে ঝুুলে আছে স্বজনদের লাশ। যে দিকে চোখ যায় শুধু লাশ আর লাশ উপকূলের বাতাসের কানপাতলেই মৃত্যু পথযাত্রি শত মানুষের চিৎকার আর স্বজনদের আহাজারি ১ ১ বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের দুঃসহ সৃতি আজও জেগে আছে স্বজনহারাদের মাঝে দুঃখ স্বপ্নের মত আজও তাড়া করে তাদের। আজও ভুলতে পারেনি সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি। স্বজন হারানো বেদনায় আজও তারা কাঁদে। একদিকে সরকারি ভাবে দিনটিকে স্মরণ করা না হলেও স্বজন হারা মানুষেরা মিলাদ মাহফিল , দোয়া মনাজাত কোরআনখানি ও নানাবিধ পারিবারিক আয়োজনে দিনটিকে স্মরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে । সিডর তান্ডবে উপকূলসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ১৭টি জেলার ২শত উপজেলার প্রায় ১ হাজার ৭শ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসেবেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৭৩ হাজার। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল ২০ লক্ষাধিক। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় ১ কোটি।সিডরের তান্ডবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাগেরহাট জেলার শরণখোলা এবং সাউথখালি এলাকা। ব্যাপক ক্ষতি হয় সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং ঝালকাঠি জেলাতেও। সুপার সাইক্লোন সিডর ও আইলা বিধ্বস্ত বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকার মানুষ এখন জীবন বাঁচাতে দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী করণীয় বিষয় প্রশিক্ষণ নিয়ে সচেতন হচ্ছেন। সিডরের ১১ বছর পার হলেও বাগেরহাটে গড়ে উঠেনি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। এতে উপকূলবাসীর মধ্যে ক্রমস ক্ষোভ বাড়ছে। বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে জেলায় বর্তমানে ২৩৪ টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। নতুন করে আরও ২০টি নির্মান করা হচ্ছে। জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যায়ক্রমে জেলায় আরও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি এসব কেন্দ্রে যেতে নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সুবিধারসহ গৃহপালিত পশু-পাখি রাখার সুব্যবস্থা থাকে এখন থেকে এমন ডিজাইনে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ নির্মাণে জোর দেওয়া হবে’। সিডরের কালো থাবায় সেই রাতে সরকারীভাবে মৃতের সংখ্যা ৩,১৯৯ এবং নিঁখোজ ১,৭২৬ জন বলা হলেও বাস্তবে তা ছিল অনেক বেশি। বেশিরভাগ নিখোঁজদের আজও কোন সন্ধান না মেলায় প্রকৃতপক্ষে ৫সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।সেদিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপে সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নিম্নচাপটি কয়েকবার গতি পরিবর্তন করে মধ্যরাতে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করে। রাতে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্তউত্তর-পূর্বমুখি হয়ে ভারত-বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখন্ডে আঘাত হানতে শুরু করে। ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ’ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ ছিল অনেক লম্বা। সে রাতে সাগরপাাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দুরে বরিশাল পর্যন্ত একই সাথে প্রায় সমান বেগে সিডরের নারকীয় তান্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি ঘূর্ণিঝড়-সিডর’র তীব্রতা ছিল সোয়া ২শ’ কিলোমিটার। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে পিরোজপুর-ঝালকাঠী বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল। একইভাবে ঝরটি পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার পশ্চিমভাগেও আঘাত হানে। প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগের ঐ ঝড়ের সাথে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপক‚লের বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদ সহ ফসলী জমিকে লন্ডভন্ড করে দেয়। সেদিন ভয়াবহ ঐ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপক‚লীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশী আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ’ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ’ ইউনিয়নে ক্ষতি ছিল সর্বাধীক। সরকারী হিসেবে ক্ষতিগস্থ পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ধরা হলেও বেসরকারী মতে তা ছিল অন্তত ২০ লাখ। সিডরের রুদ্র রোষে সেদিন সম্পদহানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সেদিন সিডর ধ্বংসলীলা চালায় সুন্দরবনের একাংশের উপরও। গবাদি পশু, ফসল সবকিছু হারিয়ে আশ্রয়হীন হয় কয়েক লাখ মানুষ।বাগেরহাট. পিরোজপুর,বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও ঝালকাঠী বাগেরহাট জেলার প্রায় হাজার কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক বেড়ীবাঁধই মাটিতে মিশে গিয়েছিল। প্রায় পৌনে ৭ শ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কসহ পল্ল¬ী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ সরকারী বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড় ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেতু ও কলাভার্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ছিল উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১,৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯০০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সিডরের রাতে উপকূলসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল জনপদের প্রায় ৪লাখ ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। আরো প্রায় ১০ লাখ ঘর-বাড়ী আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সাথে প্রায় ২লাখ হেক্টর জমির আমন ফসল সম্পূর্ণ ও আরো ৫লাখ হেক্টরের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে সিডরের কালো রাত্রির তান্ডবে।সিডরের কালো থাবায়। এছাড়াও প্রায় পৌনে ৭শ’ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ’ সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড় ৬হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেতু ও কলাভার্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও ছিল উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১ হাজার ৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ এবং অঅরো প্রায় ৯শ’টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সিডরের সে ধ্বংসলীলা এখনো গোটা উপকূলবাসী কে তারা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *