নীতিমালা না থাকায় চরম পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে খনি এলাকায়
মো: আফজাল হোসেন ফুলবাড়ী দিনাজপুর প্রতিনিধি: দেশের উত্তর অঞ্চলের ও বাংলাদেশের একমাত্র স্বল্প মাপের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি অপেন মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা না তোলায় ৮০ ভাগ কয়লা মাটির নিচে থেকে যাচ্ছে। সাময়িক লাভের মুখ দেখলেও ৮০ ভাগ কয়লা তোলা হচ্ছে না। ভূ-গর্ভ থেকে মাত্র ১৫-২০% কয়লা তোলা হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন পদ্ধতিতে। যা ১৪ শত ফিট নিচ থেকে শুড়ঙ্গ পথে তোলা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে কয়লা বেশ কয়েকটি দেশে তোলা হলেও শ্রমিকদের জীবনের ঝুকি বাড়ায়। যেমন, ভারত, চীন, অষ্ট্রলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে আন্ডাগ্রাউন পদ্ধতিতে কয়লা তুলে আনা হচ্ছে। তবে, উন্নত প্রযুক্তিতে ওপেন পিট পদ্ধতিতে কয়ল তুলতে যেমন খরচ কম, নিরাপত্তার ঝুকি কম ও ৯০ ভাগ কয়লা তোলা সম্ভব। বাংলাদেশের জ্বালানী চাহিদা মিটানোর জন্য উত্তর অঞ্চলের দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পটি ১৯৯৪ সালের ৭ জানুয়ারী তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছোটো মাপের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন সরকার দ্রæত পদক্ষেপ নেন। অল্প সময়ের মধ্যে পেট্রবাংলার সাঙ্গে চীনের মেসার্স চায়না মেশিনারীং ইনপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি)’র সাথে জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরীত হয় ১৯৯৪ সালের ১লা জুন। চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাসের মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি বাস্তাবায়নের জন্য বড়পুকুরিয়া এলাকায় জমি অধিগ্রহন শুরু করেন। প্রায় ৩শত একর জমির উপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন। ১৯৯৮ সালের ৫ এপ্রিল খনির ভূ-গর্ভে পানি প্রবাহের কারনে খনিতে বিপর্যয় দেখা দিলে কয়লা খনি প্রকল্পের কাজ প্রায় ২২ মাস বন্ধ থকে। ২ বছর পর ২০০৩ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ করার কথা থাকলেও তা করতে পারেননি। খনির ডিজাইন পরিবর্তন করে নতুন ডিজাইনে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রকল্পের কাজ তৎকালীন আবারও ৪ বছর পিছিয়ে যায়। ফলে প্রকল্পের ব্যায় আরো ৫ শত কোটি টাকা বেড়ে যায়। প্রথম প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যায় ধরা হয়েছিল ৮শত ৮৭ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা। সব মিলিয়ে ব্যায় করা হয় ১হাজার ৪শত ৩১ কোটি টাকা। দেশের উত্তর অঞ্চলের আবিষ্কৃত ৫টি কয়লা খনিতে মজুত ৩১৯৭ মিলিয়ন টন কয়লা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানীর উৎস গ্যাস। বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে গ্যাসের উপর চাপ বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে। এছাড়া দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস নির্ভর। দেশের গ্যাস মজুদ যেহেতু অফুরন্ত নয়, তাই আগামী দিনে বিকল্প জ্বালানী হিসাবে কয়লার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে উত্তর অঞ্চলের ৫টি কয়লা খনি। দেশে আবিষ্কৃত কয়লা ৫৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য, যা দেশে এ পর্যন্ত আহরিত গ্যাসের প্রায় ৪গুন বেশি। দিনাজপুরের ৩টি আবিষ্কৃত খনি বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী ও দীঘীপাড়া। অপরদিকে আরও ৩টি খনি হচ্ছে রংপুরের খালাশপীর ও জয়পুর হাটের জামালগঞ্জ। শুধু দিনাজপুরের আবিষ্কৃত কয়লা খনিতে মজুদ রয়েছে ১হাজার ৪শত ৬২ মিলিয়ন টন কয়ল। পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হলেও ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন চলছে। ৬.৬৮ বর্গকিলোমিটার কয়লা ক্ষেত্রে ১১৮ থেকে ৫০৬ মিটার গভীরতায় ৬টি স্থরে কয়লার মজুদ ৩৯০ মিলিয়ন টন। এখানে উৎপাদিত কয়লায় সালফারের পরিমান ০.৫৩%। ২০০১ সাল থেকে শুরু করে ১৯ জুলাই ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১,০১,৬৬,০৪২,৩৩ মেট্রিকটন কয়লা উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত কয়লার মূল্য পায় ২শত ৩০ কোটি টাকা। ১৯৮৫ সালে বিওএইচপি নামক একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান ফুলবাড়ী পার্বতীপুর, বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে আর একটি কয়লা খনি আবিষ্কার করেন। ১৯৯৭ সালে লন্ডন ভিত্তিক এশিয়া এনার্জি নামে একটি বহুজাতিক কোম্পানী এই এলাকায় ১০৭টি কূপ খননের মাধ্যমে উন্নতমানের কয়লা আবিষ্কার করেন। এই কয়লা খনিতে ৬.৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৫শত ৭২ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ নিদ্ধারন করা হয়। ফুলাবাড়ী পৌর এলাকার কিছু অংশ ও পার্বতীপুরের ১টি ইউনিয়ন ও নবাবগঞ্জের ২টি ইউনিয়ন, বিরামপুরের একটি ইউনিয়ন নিয়ে এই বিশাল কয়লা বেসিনটি। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী খনি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিলে দেশি-বিদেশীরা সড়যন্ত্র করে বিরোধীতা শুরু করে স্থানীয় লোকজন দিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই এক পর্যায়ে গত ২৬ আগষ্ট ২০০৬ সালে ঢাকায় বাম সংগঠনগুলি জাতীয় তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি গঠন করে সেই ব্যান্যারে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়ে জনগণ কে ভুল বুঝিয়ে ফুলবাড়ীতে আন্দোলন গড়ে তোলেন ও ২৬ আগষ্ট অনাকাঙ্খিত ঘটনায় ৩ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে বিদেশী কোম্পানীটি ২শত কোটি মার্কিন ডলার যার অর্ধেকের বেশি ব্যায় করেছে ফুলবাড়ীর খনি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। কিন্তু কোম্পানীটির দূর্ভাগ্য সরকার এবিষয়ে কোম্পানীকে কোন কার্যক্রম করতে দিচ্ছেন না। বাধা দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে ফুলবাড়ীর পার্শবর্তী কয়লা খনির কার্যক্রম মোটেই বন্ধ করতে পারেননি। রীতিমত রাট্রীয় কোম্পানীর মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন চলছে। বর্তমান ভূ-গর্ভস্থ কয়লার পয়েন্ট শেষ হওয়ার পথে। নর্থ এবং সাউথ দুটি এলাকাকে কোল জোন তৈরী করে জরিপের কাজ চলছে। ৪ বছরের মধ্যে অপেন মাইনিং অথবা আন্ডারগ্রাউন পদ্ধতিতে কয়লা তোলার নতুন পরিকল্পনা চলছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রাম ও ১৯শত একর জমি ধ্বংস হয়ে যাবে। এলাকার পূর্বে যা ক্ষতি হয়েছে তার তিনগুণ ক্ষতি হবে এই এলাকায়। পরিবেশের বিপর্যয় ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। চৈত্রী মাস এলে এই এলাকায় ভয়ানক পানির সমস্যা দেখা দেয়। কোথাও কোন পানি পাওয়া যায়না। আবাদি জমিগুলিতে কৃষকেরা সেচ পাম্পের মাধ্যমে ভূ-গর্ভ থেকে পানি তুলে চাষাবাদ করতে পারেনা। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে প্রতি ঘন্টায় পানি প্রবাহ রয়েছে ১হাজার ৮শত মিটার কিউবিক। সেই সঙ্গে রয়েছে রূফ ফল্ট। শত প্রতিকূলতার মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন চলছে। তবে পার্শ্ববতী ৫শত ২৫ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে এই খনির কারনে। এখানকার কয়লা দিয়ে ৫শত ২৫মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখা হবে। অপরদিকে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার দীঘিপাাড়া কয়লা খনিটি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ভূ-তাত্তি¡ক জরিপ অধিদপ্তর এই খনিটি আবিষ্কার করে। দীর্ঘ ১ যুগ ধরে বেশ কয়েকটি কূপ খনন করে ৫শত মিলিয়ন টন কয়লা মজুদের পরিমান যাচাই করেন। বর্তমান বাংলাদেশ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রানালয়ের আওতায় বিসিএমসিএল এর মাধ্যমে ৩বৎসর মেয়াদী জরিপ কাজ চলছে। জরিপ কাজ শেষে চীনা কোম্পানী দীঘিপাড়া কয়লা খনিটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিবেন। এই খনিটির তদারক করছেন প্রকল্প পরিচালক মো: জাফর সাদিক। উত্তর অঞ্চলের ৪র্থ কয়লা খনি হচ্ছে জয়পুর হাটের জামালগঞ্জ। ১৯৬৫ সালে সার্ভে করে ভূ-গর্ভের মজুদ কয়লা নিদ্ধারন করেন ১হাজার ৫শত মিলিয়ন টন। ভূ-গর্ভের ৯শত থেকে ১হাজার গর্ভীরে ১৬বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কয়লা রয়েছে। ৫ম কয়লা খনিটির অবস্থান হচ্ছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার খালাশপীর নামক স্থানে। ১৯৯৫ সালে আবিষ্কৃত ১১ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ২৫৭ থেকে ৪৮৩ মিটার গভীরতায় কয়লার মজুদের পরিমান ৬শত ৮৫ মিলিয়ন টন। এই ৫টি খনির মজুদ কয়লা জ্বালানী খাতে সহায়ক হবে। দেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের যেসব কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশিও অর্থে তৈরী করা হচ্ছে সেই সব কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ না থাকলে এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার উত্তর অঞ্চলের ৫টি কয়লা খনি বাস্তবায়ন না করে তেল ও গ্যাস এর উপর নিরর্ভর করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে পাশ্ববর্তী দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানী করা হচ্ছে। যা দেশের জন্য মঙ্গল জনক নয়। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এই এলাকার কয়লা খনিগুলি বাস্তবায়ন করা হলে এক দিকে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। কিন্তু সরকার ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া কয়লা খনি দু’টি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর চীনা কোম্পানীকে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন পদ্ধতিতে কয়লা তুললে এই খনিগুলির ভূ-গর্ভে মজুদ কয়লার অফুরন্ত ক্ষতি সাধন হবে। ৮০ভাগ কয়লা ভূ-গর্ভে থেকে যাবে, ২০ভাগ কয়লাও উঠবে না, ব্যায় বাড়বে সরকারের। জার্মানীর মত উন্নয়নশীল দেশ তাদের ভূ-গর্ভে মজুদ কয়লা ওপেন পিট পদ্ধতিতে তুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তাদের দেশের কয়লা আমাদের দেশের মত নয়, তারা চিন্তা করে ৫০ বছরের জন্য জ্বালানী মজুদ করছে। এমনকি খনি এলাকার কিছু মানুষকে অন্যত্র এলাকায় পূর্নবাসন করেছে। তাদের দেশের পরিবেশের কোন ক্ষতি হয়নি। কিছু সমস্যা রয়েছে যে সমস্যাগুলির মধ্যে ছিল তাদের পূর্নবাসন, চাকুরী এবং জীবন জীবিকার জন্য উন্নত ব্যবস্থা করা তাই করেছে সে দেশের সরকার। জার্মানির সেই সব অভিজ্ঞতা ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে তো কয়লা তোলা অতি সহজ ব্যাপার। কিন্তু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি বাস্তবায়নে গিয়ে ঐ এলাকার ক্ষাতিগ্রস্ত মানুষদেরকে পূর্ণবাসনে আশ্বাস দিয়ে যে সব করার কথা ছিল তা সরকার করেননি। ফলে এখন ঐ এলাকায় কয়লা তোলার কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। চারিদিকে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য কয়লার ছোট ছোট মজুদ। সেখান থেকে কয়লার এ্যশ উড়িয়ে বাতাসের সাথে মিশিয়ে রবিশষোর চরম ক্ষতি সাধন হচ্ছে। বাসা বাড়িতে কালো ধোঁয়া ও ছাইয়ে পরিবেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ নিয়ে এলাকায় কত ধরনের আন্দোলনও হয়েছে। পরিবেশ বাদিরা এই এলাকায় এসে তা স্বচখে দেখেছেন এই এলাকার মানুষ কি অসুবিধার মধ্যে থাকেন। অপরদিকে জ্বালানী সংঙ্কট রয়েছে উত্তর অঞ্চলে। কয়লার পুড়িয়ে এই এলাকার জ্বালানীর চাহিদা মিটানো সম্ভব। তাতে এই এলাকায় কৃষি ও শিল্পতে বিপ্লব ঘটবে।