প্রশ্নফাঁস জালিয়াতি চক্রের মোট ২৮ জন গ্রেফতার
বিসিএস, ব্যাংক ও সরকারি চাকরির পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস জালিয়াতি চক্রের মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার পর তা আলিয়া মাদরাসা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে বসে সমাধান করা হতো। পরে সেগুলো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করতো প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের সদস্যরা। চক্রটি বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেছে। এই জালিয়াতির মাধ্যমে তারা চক্রটি বিভিন্নজনের কাছে প্রশ্ন সরবরাহ করে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটির মূল হোতাসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে সিআইডি। গত কয়েকদিন থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ইব্রাহিম (২৮), আইয়ুব আলী (বাধন), মোস্তফা কামাল (২৮), মনোয়ার হোসেন (৪২),নুরুল ইসলাম (৪৭), হাসমত আলী সিকদার, হোসনে আরা বেগম, গোলাম মোহাম্মদ বাবুল ও অলিপ কুমার বিশ্বাস। তাদেরকে সিরাজগঞ্জ ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার (৯ আগস্ট) রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত সিআইডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, ভর্তি কিংবা নিয়োগ পরীক্ষায় মূলত দু’ভাবে জালিয়াতি হয়। একটি চক্র আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করত। আরেকটি চক্র পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তা সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করতো। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আরও ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, গত পাঁচ দিনের এক সাড়াশি অভিযানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডিজিটাল ডিভাইস চক্রের মাস্টার মাইন্ড বিকেএসপির সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস, বিএডিসির সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল, ৩৬তম বিসিএসে নন ক্যাডার পদে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত ইব্রাহিম এবং ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণ আয়ুব আলী বাঁধনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে প্রশ্নপত্র সরবরাহের অভিযোগে রাজধানীর অগ্রনী স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক গোলাম মোহম্মদ বাবুল, অফিস সহায়ক (পিওন) আনোয়ার হোসেন মজুমদার এবং মো: নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। একই অভিযোগে ধানমন্ডি গভ.বয়েজ স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হোসনে আরা বেগম এবং পিয়ন হাসমত আলী শিকদারকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের সময় হাসমতের কাছে ওই দিনের বিসিএস লিখিত পরীক্ষার কয়েক কপি প্রশ্নপত্র এবং ৬০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। এই ৯ জনসহ এ মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৭।চক্রটি ২০১২ সাল থেকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নয়, মেডিকেল, ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে বলে দাবি করেন তিনি। গ্রেফতারকৃত বিকেএসপির সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতির মাস্টার মাইন্ড। কয়েক বছরে সে জালিয়াতির মাধ্যমে তিন কোটি টাকার বেশি আয় করেছে। অন্যদিকে গ্রেফতারকৃত ইব্রাহিম, মোস্তফা ও বাঁধন বিসিএসসহ সকল নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির মূলহোতা।
গ্রেফতারকৃত অলিপ, ইব্রাহীম, বাঁধন ও মোস্তফা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁসের পর রাজধানীর আলিয়া মাদরাসা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে আনতো। তারপর সেই হলের দুটি কক্ষে বসে তারা অভিজ্ঞদের দিয়ে সে প্রশ্নপত্র সমাধান করাতো। ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীর কাছে সরবরাহ করত। এজন্য তারা প্রশ্নপত্র কেন্দ্র থেকে টাকা দিয়ে কিনে আনা, সমাধান ও যাবতীয় টাকা পয়সা সমন্বিতভাবে খরচ করতো। পরে সেই টাকা তারা পাওয়ার পর সমান করে ভাগ করে নিতো বলে জানান মোল্লা নজরুল। গত বছরের ১৯ অক্টোবর গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতের ঘটনায় পরদিন ২০ অক্টোবর শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছিল। মামলার পর মাস্টার মাইন্ড নাটোরের ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এছামীসহ এই চক্রের ২৮ আসামী গ্রেফতার করেছিল সিআইডি। মোল্লা নজরুল মনে করেন, প্রেস বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যারা এনালগ পদ্ধতিতে প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস করে থাকে তাদের আইনের আওতায় আনা যতটা সহজ তার চেয়ে ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বনকারীদের আইনের আওতায় আনা ততটাই জটিল। সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি অর্গানইজড ক্রাইমের অতি: পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান, অতি: পুলিশ সুপার আসলাম উদ্দিন, অতি: পুলিশ সুপার শিরিন সুলতানা, অতি: পুলিশ সুপার সুমন মিয়া, সিনি: এএসপি আবু সাঈদ, সিনি: এএসপি শারমিন জাহান ও সিনি: এএসপি সুমন কুমার দাস উপস্থিত ছিলেন।