শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষিকার ১০ লক্ষাধিক টাকার দুর্নীতি ফাঁস


সাহিদুল এনাম পল্লব, ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে গত এক বছরে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রিশনের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, মেনিজিং কমিটির সভাপতি স্বাক্ষর ছাড়া একক ভাবে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন,বিভিন্ন অজুহাতে অনুস্থানের নামে চাঁদা তুলে আত্মসাত করা সহ বিভিন্ন ভাবে প্রায় ১০ লক্ষ টাকার তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠেছে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে। তাছাড়া শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ,নীতিমালার বাইরে হ্যান্ডক্যাশ উত্তোলন,নির্ধারিত নোট বই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা এবং তার টাকা আত্মসাতের বিদ্যালয়ের বিভিন্ন রেজুলেশনে টাকা উত্তোলনের স্বাক্ষর বিহীন নোটশীট,অনিয়ম আর জাল-জালিয়াতির নথি ফাঁস হয়ে গেছে।প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ ফজলুর রহমানের লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে,রেজুলেশান ও নোটশীটে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সহি-স্বাক্ষর ছাড়াই কখনো টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কমিটির অনুমোদন ছাড়া অর্থ ব্যয় আবার কখনো সাধারণ তহবিল ব্যতিত বিদ্যালয়ের নামে কৌশলে নতুন একাউন্ট করে চেকে একক স্বাক্ষরেই চলছে টাকা উত্তোলন । কখনো বা বিল-ভাউচার জালিয়াতি, ফরম পূরণ-রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, নীতিমালার বাইরে হ্যান্ডক্যাশ উত্তোলন, নির্ধারিত নোটবই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা, বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা তুলে আত্মসাত, ৫০ শতাংশ হারে বেতন উত্তোলন করে থাকে। ক্ষমতার অপব্যবহার সহ শিক্ষক-কর্মচারীর অনেকের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ বিদ্যালয়ের বেতন-সেশন হঠাৎ দ্বিগুণ বৃদ্ধি,বিভিন্ন সময়ে প্রধান শিক্ষিকা ছুটিতে থাকা কালে নিয়ম অনুযায়ী সহকারী প্রধান শিক্ষকের উপর দায়িত্ব দেয়ার নিয়ম থাকলেও জুনিয়র শিক্ষকদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয় যা চাকুরী বিধি লঙ্ঘন,গত ১১ মাসে ৪ জন শিক্ষককে অন্যায় ভাবে শোকজ নোটিশ দেয়া। এছাড়া তার অনুগত না থাকলেই তার বিরুদ্ধে শোকজের হুমকি দেয়া হয়। তার মতের বাইরে কোন শিক্ষক-কর্মচারীকে মানবিক কারণেও ছুটি মঞ্জুর করে। সহকারী প্রধান শিক্ষক সহ কয়েক শিক্ষকের নিয়োগ ফাইল, মূল সনদ গায়েব করে দেয়া। লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে,২০১৭ সালের জেএসসি পরীক্ষার ফরম পুরনে ২০হাজার টাকা, এসএসসি পরীক্ষার ফরম পুরনে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা ও নবম-দশম শ্রেণীর ফরম পূরণের ১৮ হাজার ৪২০ এবং ৮ হাজার ৮০০ টাকা জমা হয়নি। তাছাড়া ২০১৭ সালে পরীক্ষার খাতা-বই বিক্রি বাবদ ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা, জরিমানা আদায় বাবদ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা প্রাইভেট পড়ানো বাবদ শিক্ষকদের কাছ থেকে ২৬ হাজার টাকা জমা হয়নি। ড্রাম সেট ক্রয় বাবাদ শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে ১০ টাকা করে উঠান ১৫ হাজার টাকা বিদেশ সফরে ব্যক্তিগত আপ্যায়ন বাবদ ১০ হাজার টাকা খরচ দেখালেও ভাউচারের মাধ্যমে আবারো ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের নামে সোনালী ব্যাংকে (একাউন্ট নং-২৪২১৬০১০২১২৯৯) নতুন একাউন্টে প্রধান শিক্ষিকার একক স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যাবে। সেখানে রাখা হয়েছে ৬৩ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফিস বাবদ ২৭ হাজার ৮৫০, ষষ্ঠ শ্রেণির রেজিষ্ট্রেশন বাবদ ১০ হাজার টাকা জমা দেয়া হয়নি। বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষিকা শতভাগ বেতন ভাতা পাওয়ার পরেও ৫০ শতাংশ হারে প্রতিমাসে ১৪ হাজার ৫০০ করে মোট ৫৮ হাজার টাকা ও প্রতিমাসে হ্যান্ডক্যাশে ৫ হাজার করে মোট ৫৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। এছাড়া ২০১৮ সালে শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রাইভেট বাবদ ১৫ হাজার ভুয়া ভাউচারে সাউন্ডসিস্টেম বাবদ ৫ হাজার,এসএসসি বিজয়ীদের উপহার বাবদ ছাত্রীদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হলেও ভুয়া ভাউচারে আবার ২১ হাজার ৭২৫, বেঞ্চ ক্রয় বাবদ ভুয়া ও কাটাকাটির ভাউচারে ১০ হাজার,এসএসসি উন্মুক্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা হারে চাদা ২৪ হাজার ৫০০,২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জরিমানা বাবদ ৬০ হাজার টাকা ও ছাত্রী ভর্তি বাবদ ৩ লাখ টাকা, এসএসসির প্রশংসা পত্র বাবদ ২৫০ টাকা হারে ৪৩ হাজার ২৫০ টাকা আয় হলেও তা হিসাবে জমা করা হয়নি। এভাবে ১০ লাখ ২০ হাজার টাকার উপরে আত্মসাত করেছে । তাহাছাড়া কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ থেকে জানা যায় যে ২০১৮ সালে ফরম পূরণের জন্য বোর্ড নির্ধারিত ১৫৭৫ টাকার বাইরে ১৯৪০ টাকা হারে কখনো ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত করে আদায় করা হয়েছে এবং বাধ্যতামূলক ভাবে বিভিন্ন কোম্পানীর গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করা হয়েছে সেখান থেকে আসা লভ্যাংশ সব আত্মসাত করেছে।তার এসব বিষয় নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জনও করে সেসব অনিয়মের লিখিত ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে শিক্ষা অফিসার, জেলা প্রশাসক,শিক্ষা বোর্ডসহ দুদকেও। এই ঘটনায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী,শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। এই ঘটনায় ম্যানেজিং কমিটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন তার স্বাক্ষর ছাড়ায় রেজুলেশন,চেক সহ সমস্ত তহবিল-হিসাবে নানা জালিয়াতি করেছে প্রধান শিক্ষিকা। বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা যোগদানের পর চিরায়িত প্রথা ভেঙ্গে পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের তহবিল সংক্রান্ত যৌথ একাউন্টের বাইরে নতুন করে প্রধান শিক্ষিকার একক স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যাবে মর্মে খোলা একাউন্ট নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও শিক্ষানুরাগীদের মাঝে।২০১৭ সালের জুলাই মাসে তিনি প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই এমন অনিয়ম হচ্ছে বলে জানান ম্যানেজিং কমিটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি কাজী আশরাফুল আজম । তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাজারো ত্রুটি নিয়ে রেজুলেশান, নোটশিট, চেকসহ অন্যান্য কাগজপত্র আনা হতো, তার অজান্তে একক স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে,তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে বলে। তিনি আরো বলেন, এখন স্কুল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে এই শিক্ষিকা আসার পরে, তার মতো একজন মানুষ এখনে থাকলে স্কুলটির ভরাডুবি হবে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শৈলকুপা উপজেলা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপিঠে বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১১শত। এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও ।প্রধান শিক্ষিকার বিরুদ্ধে গত ১১ জুনে শৈলকুপা উপজেলার মাসিক আইন-শৃংখলা মিটিংএ প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল প্রধান শিক্ষিকার অনিয়ম দুর্নীতির প্রসঙ্গ!এই মিটিং এ ক্ষোভ প্রকাশ করে উপজেলা চেয়ারম্যান শিকদার মোশাররফ হোসেন সোনাও ।শৈলকুপা শহরে ফুটপাতে কলার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন আব্দুর রশিদ। তিনি জানান তার মেয়ের ফরম পূরণের জন্য ৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে প্রধান শিক্ষকের কাছে, জোর অনুরোধ করার পরেও তা শোনা হয়নি। তিনি আরো বলেন, তার মেয়ে বিভিন্ন খেলাধুলায় ভাল ছিল। এসব দিকে তাকিয়েও কোন টাকা কম নেয়া বা বোর্ড নির্ধারিত টাকা নেয়া হয়নি। সাতগাছি গ্রামের নজরুল ইসলামের মেয়ে ডলি খাতুন জানান, ফরম পূরণের ১৮০০ টাকার স্থলে কোচিংয়ের ১ হাজার টাকা সহ ৩৮ শত টাকা নেয়া হয়েছে। অথচ কোন ধরনের কোচিং করানো হয়নি ।এই বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক শামসুল ইসলাম বলেন, তার সময়ে একক স্বাক্ষরের কোন একাউন্ট ছিলো না এবং বিদ্যালয়ের সহ প্রধান শিক্ষক সহ সবার সাথে আলোচনা ও রেজুলেশন সাপেক্ষে হিসাব পরিচালনা করা হতো । তিনি বলেন বিদ্যালয়টির সুনাম যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে সবার নজর দেওয়া দরকার। আর সোনালী ব্যাংক শৈলকুপা শাখার ম্যানেজার বসির উদ্দিন জানান, ব্যাংকের হিসাব নিয়ম অনুযায়ী রেজুলেশান ও অন্যান্য নিয়ম মানা হয়েছে তবে রেজুলেশনেই উল্লেখ আছে একক স্বাক্ষরে টাকা উঠানো যাবে । যেখানে সন্দেহ হয়েছে সেখানে হলুদ কালি দিয়ে বোল্ড করা হয়েছে।এদিকে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকা দিলারা ইয়াসমিন জোয়ার্দ্দারের দাবী রেজুলেশন আর ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই স্কুল পরিচালনা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন। তার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের আনীত অভিযোগ মিথ্যা।এসব বিষয়ে শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. উসমান গনি জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি গঠন সহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে । তিনি সব কিছু খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে একটি মিটিংও করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *