প্রস্তুত গাজীপুর: ভোট ঘিরে শঙ্কা-উৎকণ্ঠা


আর মাত্র দুদিন বাদেই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট। ভোটকে কেন্দ্র করে নগরীর ভোটারদের মধ্যে বিরাজ করছে বাড়তি উত্তেজনা ও শঙ্কা। ভোট সুষ্ঠু হবে তো? নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে তো? এমন নানামুখি উৎকণ্ঠাও রয়েছে ভোটারদের মাঝে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে সময় যত ঘনিয়ে আসছে প্রার্থী ও সমর্থকেরা ভোটারদের মাঝে প্রচার-প্রচারণায় ততই ব্যস্ত হয়ে উঠছেন।
এর আগে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় দুই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের পক্ষ থেকেও পাল্টা দোষারোপ শুরু হয়। বিএনপির নেতাকর্মীরা তখন বলেছিলেন, নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় জেনেই সরকার আদালতকে ব্যবহার করে ভোট বন্ধ করেছে। আওয়ামী লীগ পাল্টা অভিযোগ ছুড়ে দিয়ে বলছিল, বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হচ্ছে ষড়যন্ত্র করা। তারা গাজীপুরের ভোট নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তবে একটি ব্যাপারে দুপক্ষই একমত ছিল, উভয়ই নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন।গত ১৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণের কথা ছিল। হাইকোর্টের আদেশে প্রথমে ভোট আটকে যায়। পরে আপিল বিভাগ সেটি প্রত্যাহার করায় বাধা কাটে। তবে নির্বাচন কমিশন দ্বিতীয় দফায় ভোটের তারিখ ঘোষণা করলে আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠে গাজীপুরবাসী। জেলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লা, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি পথেঘাটেও মানুষের মুখে মুখে এখন একটিই আলোচনা- ‘ভোট’। আর এই ভোটকে কেন্দ্র করে জনমনে কোটি টাকার প্রশ্ন- কে হতে যাচ্ছেন নতুন নগরপিতা?এদিকে ভোটকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাড়িতে সমর্থকদের ভিড় দেখা গেছে গত ক’দিন। চলছে নিজ নিজ ক্যাম্পেইনারদের হইহুল্লোড়। জাতীয় সংসদের গাজীপুর-১, ২ ও ৩ আসনের কিছু কিছু অংশ নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা গঠিত। সিটি করপোরেশনের মোট ওয়ার্ড ৫৭টি। এর মধ্যে ৩৫টি ওয়ার্ড পড়েছে গাজীপুর-২ আসনে। ১৮টি আসন আছে গাজীপুর-১ আসনের মধ্যে। আর গাজীপুর-৩ আসনে রয়েছে চারটি ওয়ার্ড। ৭ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি ভোট গাজীপুর-২ আসনের ৩৫ ওয়ার্ডে। গাজীপুর-২ আসনের ১৮টি ওয়ার্ডে আছে ৩ লাখ ২৩ হাজারের বেশি ভোট। আর গাজীপুর-৩ আসনের চার ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৬০ হাজার ৮৮৬।তিনটি আসনই দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির প্রার্থীদের হাতছাড়া। গাজীপুর-১-এ তো বিএনপি সেই ১৯৯১ সাল থেকে একবারও জিততে পারেনি। সেখানে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রহমত আলী বিজয়ী হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনের পুনর্বিন্যাসে গাজীপুর-১ আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের আ ক ম মোজাম্মেল হক। ১৯৯১ সালে একবারই আবদুল মান্নান গাজীপুর-২ আসনে বিএনপির হয়ে জিতেছিলেন। তারপর থেকেই ওই আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে।এদিকে ক্ষমতাসীনরা গাজীপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে অভিযোগ করে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেছেন, ‘দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও হয়রানি চালানো হচ্ছে। আমি এখনও বলছি, নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষা করুন। লেভেল প্লেইং ফিল্ড দিন। নইলে এমন কর্ম করবো যা চিরদিন বিশ্ব স্মরণ করবে। এবং বলবে হাসান উদ্দিন সরকার নির্বাচনের জন্য এমন কর্ম করেছিল।’ গতকাল শনিবার সকালে ‘পুলিশি হয়রানি, গণগ্রেফতার ও ভয়ভীতি প্রদর্শন প্রসঙ্গে’ নির্বাচন কমিশনে একটি লিখিত অভিযোগও দেন তিনি।আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে হাসান সরকার বলেন, ‘আমরা যেন কলহ না করি, বিরোধ না করি, আমরা যেন কারও সর্বনাশ না করি। আমরা যেন শান্তির পথে চলি। কারণ, ২৬ তারিখ নির্বাচন হয়ে গেলে আমরা কিন্তু এখানেই একসাথে থাকব। দল আলাদা হলেও আমাদের চলতে হবে একসঙ্গেই।’ তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের প্রতি জনকল্যাণের স্বার্থে রাজনীতি করার আহ্বান জানান। এদিকে পাল্টা অভিযোগ ছুঁড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিএনপির মেয়র প্রার্থী নানা রকম মিথ্যাচার করছেন।’ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে এসব মিথ্যাচার থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আপনি (হাসান সরকার) একজন মুরুব্বি মানুষ, মিথ্যাচার না করে মানুষের প্রতি সম্মান থাকা উচিত। মাঠে এসে মানুষের কাছে ভোট চাওয়া উচিত।’নির্বাচন ‘শতভাগ সুষ্ঠু’ হবে মন্তব্য করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ নির্বাচন পাহারা দেবে, সেখানে সুষ্ঠু না হওয়ার কোনো পথ নাই। পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষের অনুকূলে আছে শতভাগ। যারা ভোট দিবেন তারা বৃষ্টি, রৌদ্র যেখানে যে অবস্থায় আছে, ঈদের মধ্যে যারা বাহিরে ছিল তারাও আজকে গাজীপুরে চলে আসছে। তারা আওয়ামী লীগ ও নৌকাকে ভোট দিতে চায়, তেমনি এলাকার উন্নয়নও চায়। আমি তাদের জন্য নিরাপদ, ক্লিন ও গ্রিন একটি শহর উপহার দিতে চাই।’এদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট ঘিরে ৮০ শতাংশ কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিটিতে মোট ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৩৭টি কেন্দ্রকেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে অতিরিক্ত পুলিশ ও আনসারের সদস্য মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় এবং এর পেছনে যদি প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’সম্পতি খুলনা সিটি নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল- সাংবাদিকদের এমন মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে সিইসি বলেন, ‘প্রশাসন নির্বাচন “স্টাফিং” (ভোট জালিয়াতি) করেছে- এই বক্তব্য আমি প্রত্যাখ্যান করি। প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করছে, নির্বাচন (গাজীপুর সিটি) সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কোনো কারণে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বা প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’নির্বাচনের দিন ভোটাররা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত-এমন উদ্বেগ নাকচ করে দিয়ে সিইসি বলেন, ‘গাজীপুর এত বড় সিটি। তফসিল ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত এখানে (গাজীপুর) কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আশা করছি, নির্বাচনের দিনও পরিবেশ ভালো থাকবে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।’আওয়ামী লীগ মনোনীত জাহাঙ্গীর আলম এবারই প্রথম মেয়রের মতো বড় কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৩৯ বছর বয়সী জাহাঙ্গীরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ প্রতীকের হাসান উদ্দিন সরকার। মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার এরশাদের সামরিক শাসনামলে দুই দফায় জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি টঙ্গী পৌরসভা চেয়ারম্যান হিসেবেও দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এক মেয়াদে গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ৭০ বছর বয়সী হাসান সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *