আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে বাংলাদেশের পতাকা প্রস্তুতকারকরা নির্ঘুম
আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা প্রস্তুতকারকরা। তবে দেশের নয়, মোটা অংকের ব্যবসার জন্য তারা বেছে নিয়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা এবং নেইমারের ব্রাজিলীয় পতাকার রং-কে।রাজধানী ঢাকার নিকটে মেরাজ নগরে একটি ছোট্ট কারখানা স্থাপন করেছে টেক্সটাইল প্রিন্টার কামাল হোসেন। আসন্ন রাশিয়া বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সেখানে বিরতিহীনভাবে চলছে পতাকা বানানোর কাজ। যে পতাকাগুলো বিক্রি হবে স্থানীয় বাজারে। তিনি বলেন, ‘গত দুই মাস আমি বিরতিহীনভাবে কারখানা চালু রেখেছি। এমন অনেক দিন গেছে আমি দুই ঘণ্টাও ঘুমাইনি।’ স্ক্রিন প্রিন্টিং মেশিনে সারাক্ষণ কাজ করে চলেছেন ৪০ বছর বয়সি কামাল।ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশীরা ক্রিকেট পাগল জাতি। কিন্তু প্রতি চার বছর পরপর যখন বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয় তখন ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশটি নাওয়া-খাওয়া ভুলে মেতে উঠে ফুটবল উন্মাদনায়। অথচ বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার অধিভুক্ত বিশ্বের ২০২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থান ১৯৭তম।আগামী ১৪ জুন মস্কোতে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হবার আগেই বাংলাদেশের রাজপথসহ আনাচে-কানাচে ছেয়ে যাবে এসব পতাকায়। যেখানে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার আধিক্যই বেশি। এ উপলক্ষে শুধুমাত্র মেরাজনগরেই হাজার হাজার পতাকা তৈরি হবে বলে আশা করছে প্রস্তুতকারকরা।কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন হাজার হাজার পতাকা বানিয়ে প্রিন্ট দিচ্ছি। আজও আমরা ১১ হাজার আর্জেন্টিনার পতাকা প্রিন্ট করেছি।’প্রিয় দলের পক্ষে প্রতিদিন বাংলাদেশের সমর্থকরা পতাকা উড়িয়ে মিছিল করছে। এরপর সেই মিছিলের ধারণকৃত ভিডিও প্রচার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গত সপ্তাহে আনুমানিক ২০০ মিটার দীর্ঘ আর্জেন্টাইন পতাকা নিয়ে মিছিল করেছে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মাদারগঞ্জের সমর্থকরা। তাদের ওই মিছিলের ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।১৯৮২ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সরাসরি সম্প্রচারিত হয় বিশ্বকাপ ফুটবল। তবে এখানে ফুটবল উন্মাদনার সৃষ্টি হয় ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ চলাকালে। যে আসরে ‘ঈশ্বরের’ হাতের ছোয়ায় গোল করে শিরোপা ঘরে তুলেছিল দিয়াগো ম্যারাডোনার দল আর্জেন্টিনা। এরপর আর্জেন্টিনার পাশাপাশি অন্য দলগুলোরও সমর্থক সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে।পতাকা বিক্রয়কারী হকার ফারুক মিয়ার মতে, ‘এখানে আর্জেন্টিনার সমর্থক বেশি।’ তিনি মূলত পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে রাজধানীতে পতাকা ফেরী করে বিক্রি করেন। গত সপ্তাহে তিনি ৫০০টি পতাকা বিক্রি করেছেন এবং ভাল মুনাফা করেছেন। এই সপ্তাহে তিনি ৫০০টিরও বেশি পতাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা বলে চিৎকার করে পতাকা বিক্রি করেন তিনি। ‘শুরু হবার একমাস আগেই দেশে বিশ্বকাপের উন্মাদনা শুরু হয়ে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন কারখানা মালিক সেলিম হাওলাদার। আশা করছেন কয়েক লাখ পতাকা বিক্রি করতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে আমি ৮০ হাজারেরও বেশি পতাকা বিক্রি করেছি। এর অধিকাংশই বিক্রি হয়েছে বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে কিংবা শুরুর দিন। আর এবার আমি ২ থেকে আড়াই হাজার পিচ বড় পতাকা বিক্রি করছি এবং প্রতিদিন ১০ হাজার ছোট পতাকা। অথচ বিশ্বকাপ শুরু হতে এখনো কয়েক সপ্তাহ বাকী আছে।’৩৩ বছর বয়সি হাওলাদারের কর্মচারী সংখ্যা ২৫ জন। তবে তার মেরাজনগরের পতাকা কারাখানায় ২ হাজার কর্মী কাজ করছে বলে জানিয়েছেন। মেসি ও নেইমারের দলের পতাকার চাহিদা বেশি রয়েছে উল্লেখ করে হাওলাদার বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হচ্ছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। আমি আর্জেন্টিনা দলের ৫০ ফুট লম্বা পতাকা বানানোর অর্ডার পেয়েছি। আমাদের দেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। জনপ্রিয়তায় থাকা অন্য দলগুলো হচ্ছে জার্মানি, স্পেন ও পর্তুগাল।’বাংলাদেশের ৪,৫০০ এ্যাপারেল শিল্পে কাজ করে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক। যে শিল্প থেকে সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয় কোটি কোটি ডলার। তবে মানবাধিকার ও বিশেষজ্ঞদের মতে এখানকার গার্মেন্ট শিল্পের আরো উন্নয়ন প্রয়োজন। এখনো কর্মীদের মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে হয়, কর্মপরিবেশও ঝুঁকিপূর্ণ এবং বেতন কম। কিন্তু হাওলাদারের কারখানায় কাজ করে অপেক্ষাকৃত ভাল আয় করছেন ২৮ বছর বয়সি নার্গিস আকতার ও তার স্বামী মোহাম্মদ ইকবাল। নার্গিস বলেন, ‘প্রতিদিন আমরা গড়ে ৩ হাজার টাকা (৩৫ মার্কিন ডলার) আয় করি। অথচ গার্মেন্টসে কাজ করে মাসে আয় হয় মাত্র ৭০ ডলার। আমি চাই আরো অনেক মাস পতাকার এই চাহিদা অব্যাহত থাকুক।’