প্রধানমন্ত্রী নতুন কিছু ভেবে থাকলে এ নিয়ে সংলাপের আয়োজন করা উচিত ; মির্জা ফখরুল
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নতুন কিছু ভেবে থাকলে এ নিয়ে সংলাপের আয়োজন করা উচিত বলে মনে করে বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যের একদিন পর এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিমত দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (১৩ জানুয়ারি) বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।সংসদ বহাল রেখে যে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সেটি বিদ্যমান সরকারের মতোই হবে বলে দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব। তবে এর সমাধানে একটি গ্রহণযোগ্য পথ বের করতে ‘আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ’ সংলাপের কথা বলেন তিনি, ফখরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নির্বাচনকে ঘিরে বিদ্যমান সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে স্পষ্ট কোন বিধান নেই।’তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী যদি সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা হলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। কারণ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারও হবে বিদ্যমান সরকারেরই অনুরুপ।’মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবে- এমন কিছু উল্লেখ নেই। সংবিধানের ১৫তম ও ১৬ তম সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শাসনকে পাকাপোক্ত করার একটি ব্যবস্থাই করা হয়েছে মাত্র।’তিনি বলেন, ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র সবসময় সমার্থক বা সমান্তরাল হয় না। তাই যদি হতো তা হলে হিটলার ও মুসোলিনির শাসনকেও গণতান্ত্রিক বলা যেত। কারণ তাদের শাসনও সংবিধান অনুযায়ীই ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন কিছু ভেবে থাকেন, তা হলে তার উচিত হবে এ নিয়ে সকল স্টেক-হোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া। আমাদের দল মনে করে একটি আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে ২০১৮ এর নির্বাচন নিয়ে অর্থবহ সমাধানে আসা সম্ভব।’নির্বাচনকালীন সরকারের রুপরেখা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বিএনপির একটি চিন্তা-ভাবনা আছে বলেও জানান দলটির মহাসচিব।এ সময় জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যকে দিক-নির্দেশনাহীন, অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলেও দাবি করেন ফখরুল।তিনি বলেন, ‘তার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ভাষণ জাতিকে হতাশ, বিস্ময়-বিমূঢ় এবং উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই ভাষণে বিদ্যমান জাতীয় সংকট নিরসনে স্পষ্ট কোন রুপরেখা নেই। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা খুবই অস্পষ্ট, ধোঁয়াশাপূর্ণ, এবং বিভ্রান্তিকর।’ফখরুল বলেন, ‘জাতি আশা করেছিল তার প্রধানমন্ত্রিত্বের এই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার এক বছর আগেই তিনি যে ভাষণ দেবেন সে ভাষণে থাকবে স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা। একই সঙ্গে জাতীয় সংকট নিরসনে একটি স্পষ্ট রুপরেখা এবং জনগণের উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য থাকবে বিভ্রান্তির বেড়াজালমুক্ত কর্ম পদক্ষেপ। কিন্তু সেটি হয়নি।’ সরকারের উন্নয়ন মেলার সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘পাকিস্তানের স্বৈর সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার শাসনের ১০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উন্নয়ন দশক পালন করেছিলেন। গণতন্ত্রহীন তথাকথিত উন্নয়ন জনগণ গ্রহণ করেনি। পরিণতিতে তার মত লৌহমানবকে ক্ষমতা থেকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিতে হয়েছিল। বর্তমান সরকারও উন্নয়নমেলা করছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস পাকিস্তানি আমলের স্বৈরশাসক ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য যে ধরনের চমকের আশ্রয় নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও সেই একই পথে হাঁটছে।’জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া পরিসংখ্যান সঠিক নয় বলেও মনে করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘তাদের দাবির সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও একমত হতে পারেনি। জানুয়ারি, ২০১৭ এর বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রস্পেক্টাস থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশের বেশি হবে না। অথচ অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন এই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে হবে না। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য সরকারের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে। অথচ সরকার এ অর্থবছরে ৭.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। এভাবে প্রায় প্রতি বছরই প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত সরকারি প্রাক্কলেনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো দ্বিমত পোষণ করে আসছে।’বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের প্রশ্ন হলো, জনগণ কোন তথ্য বিশ্বাস করবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের একটি সহসম্পর্ক থাকার কথা। কিন্তু আমদানি রপ্তানি, বৈদেশিক র্যামিট্যান্স, ঋণ প্রবাহ প্রভৃতির সঙ্গে সরকারের প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রাক্কলনের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি করে সরকার বরাবরই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীও তাই করলেন।’মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বর্তমান সরকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের উন্নয়নের বয়ানকে দৃশ্যমান করার জন্য কোশেস করছে। মেগা-প্রকল্পগুলো নিয়ে গণমাধ্যম ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় ভারত, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় দুই থেকে তিন গুন বেশি। সঠিক সময়ে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় একাধিকবার প্রকল্প-ব্যয় সংশোধন করতে হচ্ছে । ফলে এ সব প্রকল্প থেকে কল্যাণ সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে।’এ সময় ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার বেইল আউট প্রোগ্রামের আশ্রয় নিয়েছে। বেইল আউট প্রোগ্রামের ফলে বাড়তি করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টরের লুটপাট থেকে লাভবান হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি। এসব লুটপাটের সঙ্গে দেশ থেকে অর্থ পাচারের যোগসূত্র রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।’যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে বাজারে চালসহ খাদ্যশস্যের দাম রেকর্ড অতিক্রম করেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘বাজারে পেঁয়াজ, ডাল ও সব্জিসহ প্রত্যেকটি খাদ্যদ্রব্যের দাম অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।’সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতাদের মধ্যে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।