বহুল বিতর্কিত ও কলঙ্কময় ১১ জানুয়ারি


আজ বহুল বিতর্কিত ও কলঙ্কময় ১১ জানুয়ারি। ২০০৭ সালের এই দিনে পশ্চিমা শক্তি ও প্রতিবেশী একটি দেশের মদদে ঘটেছিল বেসামরিক মোড়কে সামরিক সরকারের আবির্ভাব। দেশে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। দেশী-বিদেশী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আগত সেই ঘটনা পরবর্তীতে কলংকিত ওয়ান ইলেভেন নামে পরিচিতি পায়। আলোচিত সমালোচিত সেই সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ইয়াজ উদ্দিন, মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দিনদের সেই সরকার তিন মাসের স্থলে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে নানা বিতর্কের জন্ম দেন। শেষ পর্যন্ত সহজ ট্রানজিট হিসেবে আওয়ামী লীগকেই বেছে নেয়। ২০০৮ সালের শেষ ডিসেম্বরে তাদের ব্যবস্থাপনায় যে নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামী মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়।
বিএনপি-জামায়াতসহ ৪ দলীয় জোট সরকারের মেয়াদপূর্তি শেষে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় মহাজোট সারা দেশে লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালায়। ঢাকার পল্টনে ৬ জনসহ সারা দেশে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে জামায়াত শিবির ও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। আহত করা হয় অনেককেই। সারা দেশে সৃষ্টি করা হয় এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। তাদের দাবি ছিল সংবিধানসম্মত বিচারপতি কেএম হাসান যেন প্রধান উপদেষ্টা না হন। এহেন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বে নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলে সংবিধান সম্মতভাবেই নির্বাচন হতে যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগের সব দাবি একের পর এক মেনে নিয়েই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু প্রার্থী দেয়ার পরও শেষ মুহূর্তে এসে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন তারা সব প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। এতে সৃষ্টি হয় আরো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার।এহেন উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরণে গঠিত হয় সেনানিয়ন্ত্রিত অন্তর্বর্তিকালীন সরকার। পরবর্তীতে এটিকে ওয়ান ইলেভেন হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ঐদিন চারদিকে ছিল নানা গুজব, গুঞ্জন সাথে আতঙ্ক ও অনিশ্চিত অবস্থা। সার্বিক পরিস্থিতি ছিল থমথমে। এই অবস্থায় বিকেল চারটার দিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও কাজী জাফর উল্যাহ এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল যোগ দেন কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠক। কূটনীতিকদের মধ্যে বৈঠকে ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ডগলাস ফসকেট, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইনোওয়ে মাসাইয়েকি, ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফান ফ্রোইন ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনাটা ডেজালিয়েন। বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত বৈঠক শেষে অনেকটা হতাশ হয়ে বেরিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান তারা। কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসা থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা সরাসরি চলে যান দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির সুধাসদনের বাসায়।আওয়ামী লীগ নেতারা বের হওয়ার আধাঘণ্টা পর বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। এর নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। বৈঠক শেষে তারাও মুখ খোলেননি। সোজা চলে যান গুলশানের হাওয়া ভবনে। সেখানে তারা বৈঠক করেন দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এর আগে দুপুর পৌনে বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সঙ্গে তার বারিধারার বাসায় বৈঠক করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী।কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রধান দু’টি দলের বৈঠকের আগে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দুপুর বারোটায় বৈঠক করেন আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে। এতে কমিটির সদস্যরা ছাড়াও সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের পরপরই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বঙ্গভবনে তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। অন্যদিকে বিকেল সাড়ে চারটায় উপদেষ্টা পরিষদের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করা হয়। দু’-একজন ছাড়া উপদেষ্টাদের প্রায় সবাই বঙ্গভবনে গিয়ে বৈঠক বাতিলের খবরে ফিরে আসেন।বঙ্গভবনের বৈঠক শেষে বিমান বাহিনী প্রধান, নৌ বাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাব, বিডিআরসহ সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে সেনাসদরে বৈঠক করেন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ।রাত সাড়ে আটটায় বঙ্গভবনে পুনরায় ডাকা হয় উপদেষ্টাদের। কোনো বৈঠক ছাড়াই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে উপদেষ্টাদের অবহিত করা হয়। এ সময় উপদেষ্টাদের সবাইকে পদত্যাগের অনুরোধ জানানো হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান রাষ্ট্রপতি। একইসঙ্গে উপদেষ্টারাও পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ডক্টর ফখরুদ্দিন আহমদকে। তিনি নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন।
এসব নাটকীয় ঘটনা ও টান টান উত্তেজনা-উদ্বেগের মধ্যেই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয় ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন এবং বিপদের সম্মুখীন হওয়ায় রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।’প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে জরুরি অবস্থা কার্যকর হবে। একইসঙ্গে রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সকল মহানগর এবং জেলা শহরে কারফিউ বলবৎ থাকার ঘোষণাও দেয়া হয়।এরপর নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত সাড়ে এগারোটায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ভাষণে তিনি বলেন, একইসঙ্গে দু’টি দায়িত্ব নেয়ার পর তাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। এই অবস্থায় সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথকে সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাতে সরকারের তথ্য অধিদফতর থেকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে রাজনৈতিক সংবাদ ও সরকারের সমালোচনামূলক সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় টিভি চ্যানেলের খবর ও টকশো।বস্তুত জোট সরকারের মেয়াদ পূর্তির বেশ আগে থেকেই বিদেশী কূটনীতিকরা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কয়েকজন কূটনীতিক সরাসরি ভূমিকা রাখেন ১১ জানুয়ারির ঘটনা পর্যন্তু। তবে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর কূটনীতিকদের কিছু ভূমিকা দেখা গেলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। কার্যত বর্তমান সরকার হলো ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন সরকারেরই ফলোআপ সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *