পঞ্চগড়ে নারী চা শ্রমিকরা কম মুজুরী আর বৈষম্যের কারণে ভাল নেই


জে.ইতি পঞ্চগড় ফিরে হরিপুরঃ পঞ্চগড়ে চা চাষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করলেও কাকডাকা ভোরে সংসারের সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে চা বাগান অথবা চা কারখানায় ছুটে যেতে হয় পঞ্চগড়ের নারী চা শ্রমিকদের । কোলের বাচ্চাকে সাথে নিয়ে অথবা কারও কাছে রেখে সারাদিনের মতো কাজে বের হয়ে পড়েন এই নারীরা। রোদ,বৃষ্টি কিংবা কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে সারাদিন চা পাতা তোলা অথবা কারখানার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। কিন্তু কম মুজুরী আর মুজুরী বৈষম্য বেশীদুর এগোতে দেয়নি এই নারীদের। ভাত কাপড় আর সাবানে খূশি থাকলেও কাজ হারানোর ভয়ে অনেকেই বৈষম্য আর কম মুজুরীর কথা কারও সামনে বলতেও চাননা তারা। শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দুরে করতোয়া চা বাগান। এই বাগানের নারী শ্রমিকরা বেশির ভাগই সাঁওতাল উপজাতীর । বেশী মুজুরী দেয়ার আশ^াস দিয়ে তাদের কে পাশ^বর্তী দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে। তাদের কে থাকার যায়গা দেয়া হলেও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব নারী শ্রমিক। অন্যদিকে কাজ কম করলে টাকা দেয়া হয়না তাদের। পরেরদিন কাজে নেয়া হয়না। প্রতিনিয়ত শুনতে হয় গালাগালি আর কাজ থেকে বের করে দেয়া সহ নানা হুমকি। এই চিত্র অধিকাংশ বাগানেই। পঞ্চগড়ের চা বাগান ও কারখানাগুলোতে স্থানীয় নারী শ্রমিকরাও রয়েছেন নানা সংকটে। মাত্র দু দশক আগেও বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করে সংসারে আয় বাড়াবে এমনটা চিন্তাই করতে পারতোনা এসব নারী। অভাবের নানা টানা পোড়নে জীবন পাড় করতে হতো তাদের। ১৯৯৮ সালে শুরু হয়ে মাত্র কয়েক বছরে সমতল ভূমিতে চা চাষে বিপ্লব ঘটে যায় এই জেলায়। বিপুল পরিমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পাশাপাশি নারীদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। চা বাগানে পাতা তোলা থেকে শুরু করে চা উৎপাদনের কারখানার বিভিন্ন কাজে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও যোগ দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চগড়ে বড় আকারের চা বাগান (টি স্টেট) রয়েছে ১৬ টি। সাথে স্থানীয় চাষিদের উদ্যোগে আরও দুই সহস্্রাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের চা বাগান গড়ে ওঠেছে । এসব চা বাগানে প্রায় ১৫ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করছে। অন্যদিকে ১২টির মতো চা কারখানায় কাজ করছে আরও দুই সহ¯্রাধিক নারী শ্রমিক। এসব নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই বিধবা,বয়স্ক, দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা গৃহিনী অথবা কিশোরী। চা বাগান ও কারখানায় পুরুষদের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করে নিজেদের ভাগ্য গঠনে নারীরা এগিয়ে গেলেও কম মুজুরী ও প্রকট বৈষম্যের কারণে আতœবিশ^াস নিয়ে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারছেনা এসব নারী। সামান্য এই আয় দিয়ে নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যাওযার মতো অবস্থা তাদের । নারী শ্রমিকরা জানিয়েছেন চলতি বাজারের সঙ্গে সারাদিনের মুজুরীর টাকা দিয়ে ২ কেজী চালও কিনতে পারছেনা তারা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তাদের অবস্থা আগের চেয়েও আরও খারাপের দিকেই যাবে। চা বাগানে আট ঘন্টা পরিশ্রম করে ৪৬ কেজি পাতা তুলে পুরুষরা যেখানে ২’শ টাকা আয় করে সেখানে একই পরিশ্রম করে নারীদের কে দেয়া হয় মাত্র ১০৫ টাকা। ৪৬ কেজীর কম পাতা তুললে নারীদেরকে শুনতে হয় গালাগালি। কাজ থেকে বের করে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়। অন্যদিকে চা কারখানায় ১২ ঘন্টা পরিশ্রম করে নারীদের কে দেয়া হয় ২৬২ টাকা । একই সময়ে একই পরিশ্রম করে পুরুষরা পায় ৩০০ টাকা। তাই মুজুরী বাড়ানোর পাশাপাশি পুরুষদের সমান মুজুরী দাবি করেছেন এই জেলার নারী চা শ্রমিকরা। সদর উপজেলার নুনিযা পাড়া গ্রামের নারী চা শ্রমিক মোমেনা বেগম (৬৮) জানান, ৫ বছর আগতে বিধবা হইছু। প্রতিবন্ধি একটা ছুয়াক লে মোর সংসার । বহু কষ্টে মেয়ের বেহা (বিয়ে) দিছু। চা মেশিনত আর বাগানত কাজ করে প্রতিদিন মুজুরী পাছু দু’শো টাকা। এই টাকায় চাল হয় কিন্তু তরি তরকারি হয়না। নাস্তা পাতি হয়না। শাড়ি কাপড় হয়না। খুব কষ্টে আছি হামরা। কাঁহাকো কহা যায়না সহাও যায়না। তবে এ ব্যাপারে চাবাগানের মালিক কিংবা কারখানা মালিক,ম্যানেজার কেউই কথা বলতে রাজী হননি।
পঞ্চগড় জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রুখসানা মমতাজ মুজুরী বৈষম্যকে দু:ক্ষজনক উল্লেখ করে, বলেন, চা বাগান বা কারখানায় নারী শ্রমিকদের অতি সামান্য মুজুরী দেয়া হচ্ছে। এটা অমানবিক। ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *