দু’হাত নেই,তবুও সবক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত মণিরামপুরের কিশোর জাহিদুল

150
আনোয়ার হোসেন,মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি: ৬ বছর আগে বিদ্যুৎস্পর্শে দুই হাত হারায় কিশোর জাহিদুল ইসলাম (১৪)। তাতে কোন দুঃখ নেই তার ; নেই কোন স্থবিরতা। আপন গতিতে উদ্যাম বেগে ছুটে চলেছে সে। লক্ষ বিটিভির হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে যাওয়ার। স্বাদ জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলে যোগ দেয়ার অথবা বড় চাকুরিজীবি হওয়ার। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমনই ইচ্ছার কথা জানায় যশোরের মণিরামপুরের শ্যামকুড় ইউনিয়নের লাইড়ী মোড় এলাকার মাহাবুর বিশ^াসের ছেলে জাহিদুল। স্থানীয় ধলীগাতী হাইস্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সে। শ্রেণি শিক্ষক আব্দুল মজিদের ফেসবুকে পাওয়া ছবির মাধ্যমে জাহিদুলের খোঁজ করা। সোমবার সন্ধ্যার পূর্বে সরেজমিন গিয়ে জাহিদুলকে বাড়ি পাওয়া যায়নি। মা রাশিদা বেগম জানান ছেলে বাড়ির পাশের লাউড়ী রামনগর প্রাইমারী স্কুল মাঠে ক্রিকেট খেলছে। শুনেইতো রীতিমত অবাক। যে ছেলের হাত নেই সেই ছেলে কিক্রেট খেলে কিভাবে ? সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বড় ছেলেকে পাঠিয়ে জাহিদুলকে ডেকে আনান তিনি। এরই মধ্যে কথা হয় রাশিদা বেগমের সাথে। জানান,‘এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে জাহিদুল সবার ছোট। ৬ বছর আগে জাহিদুল যখন ৩য় শ্রেণির ছাত্র তখন পাশের একটি দো’তলা বাড়ির ছাদে উঠে বিদ্যুতায়িত হয়ে নিচে পড়ে সে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মণিরামপুর পরে সদর হাসপাতাল তারপর খুলনা আড়াইশ’ বেডে ১৩ দিন। অবশেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তিন মাস চিকিৎসা করান ছেলেকে। তিন মাসে ৬ বার অপারেশন করে পঁচা হাত কাঁটতে কাঁটতে বাম হাতের কনুইয়ের ওপরের কিছু অংশ আর ডান হাতের কনুইয়ের নিচের কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকে। তিনমাস পর ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এরপর তিন বছর কেঁটে গেছে জাহিদুলের সুস্থ হতে। তবে এখনও বর্ষা মৌসুমে তার হাতে পঁচন ধরে বলে জানান রাশিদা বেগম। তিনি বলেন,‘স্থানীয় একটি ইট ভাটায় ম্যানেজারি করে সংসার চলে মাহাবুর বিশ^াসের। এই ছেলে নিজে কিছু করতে পারবে এমনটি ভাবিনি। ফলে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর রাতেও কাঁদতাম। পরে ছেলের চঞ্চলতা দেখে মনে সাহস পাই। ভাবলাম,নিজেরা না থাকলে এই ছেলের উপায় কি হবে ? তাই ছেলেকে আবার স্কুলে পাঠাই।’
চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও বয়স বেশি হওয়ায় একই বছর ৫ম শ্রেণিতে তুলে দেয়া হয় জাহিদুলকে। সেখান থেকে জিপিএ-৪.৭৫ পেয়ে সে ভর্তি হয় পাশের ধলীগাতী হাই স্কুলে। সেখানেও ভাল করায় স্কুলের সবাই তার প্রতি খুশি। জাহিদুলের চলার পিছনে মায়ের ভূমিকা অনন্য।
রাশিদা বেগম বলেন,‘জামা,প্যান্ট নিজেই পরতে পারে। খাবার মেখে দিলে মুখদিয়ে নিজে নিজে খায়। ছেলে প্রতিবন্ধী তাই মনের গভীরে কষ্ট থাকলেও জাহিদুলের চলাফেরায় মা বিজায় খুশি। জাহিদুলের ভাই,প্রতিবেশী মামুন,আসাদুজ্জামান ও শরিফুল জানান,‘দুই হাত না থাকলেও প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে জাহিদুল স্কুলে যায়। দুই-তিন জনকে সাইকেলের পিছনে নিয়ে চালানো তার জন্য কিছুই না। গত রোজার ঈদে শুধু সাইকেল চালানো নয় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলায় গ্রামের আর দশটা ছেলের থেকেও জাহিদুল ভাল খেলোয়াড়। গ্রামের মাঠে তার সর্বচ্চো রান ১০৭। সোমবার ক্যামেরার সামনে এমন কয়েকটি কাজ করে দেখায় জাহিদুল। সে জানায়,‘ জীবনের বড় শখ ‘ইত্যাদিতে’ যাওয়ার। প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট খেলায় যোগ দিতে চায় সে। তাছাড়া লেখাপড়া করে বড় চাকরি করারও আশা তার।
ধলীগাতী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলীপ কুমার পাল বলেন,‘লেখাপড়ায় জাহিদুল খুবই ভাল। দুই হাত না থাকলেও তার লেখা খুবই সুন্দর। স্কুলের পরীক্ষায় শিক্ষকরা তাকে অতিরিক্ত সময়ও দেন। তাছাড়া কো-কারিকুলার এক্টিভেটিজেও জাহিদুল ভাল। এজন্য শিক্ষকরা তার লেখাপড়ার খরচ ফ্রি করে দিয়েছেন।’ কিছু আর্থিক সহযোগীতা পেলে জাহিদুলের সাফল্য পাওয়া সহজ হত বলে মনে করেন এই প্রধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *