তদন্তে নেমেছে এনবিআর, ফের বড় অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকি চার মোবাইল কোম্পানির!
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক: চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানি ফের বড় অঙ্কের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ফাঁকি দিয়েছে বলে মনে করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিষয়টি তদন্তে নেমেছে এনবিআর। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মোবাইল ফোনের সিম পরিবর্তনের নামে নতুন সিম বিক্রির মাধ্যমে এই ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কী পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে-তা তদন্তে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সমপ্রতি বৃহত্ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনারকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলটিইউ-ভ্যাট ধারণা করছে, এ অর্থের পরিমাণ প্রায় এক হাজার দুই শ’ কোটি টাকা হতে পারে। কোম্পানি চারটি হলো গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, এয়ারটেল ও রবি (বর্তমানে রবি ও এয়ারটেল একীভূত হয়ে রবি নামে চালু আছে)। এর আগে ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে একইভাবে সিম পরিবর্তনের নামে ২ হাজার ৪৮ কোটি টাকার ফাঁকি চিহ্নিত করেছে এনবিআর। সুদসহ এটি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। বহুল আলোচিত ইস্যুটি হাইকোর্ট ঘুরে বর্তমানে এনবিআরের ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন করে ৫ বছরের সিম পরিবর্তনের তথ্য পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার পর অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আগের বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই নতুন এ উদ্যোগে তারা প্রশ্ন তুলেছে। সূত্র জানিয়েছে, এ তদন্ত প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে বিভিন্ন মহলে চেষ্টা-তদবিরও চলছে। এর বাইরে কয়েকটি মোবাইল ফোন কোম্পানির আয়কর ও শুল্ক বিষয়েও মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এ রকম বেশকিছু বিরোধ বর্তমানে এনবিআরের আপিলাত ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও আদালতে বিচারাধীন। অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো মোটা অঙ্কের ব্যবসা করলেও সরকারের প্রযোজ্য রাজস্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম করছে। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও লোকবলের অভাবে সব অনিয়ম ধরাও যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে তারা কৌশলে এ কাজ করে যাচ্ছে। যতটুকু ধরা হচ্ছে, সেটিও মামলায় আটকে রাখার কৌশল নিচ্ছে। এলটিইউ-ভ্যাটের কমিশনার মতিউর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত আমরা যত দাবিনামা জারি করেছি, চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে তার প্রায় শতভাগই আমাদের পক্ষে এসেছে। অথচ দাবিনামা জারি করা হলেই তারা হাইকোর্টে রিট করে। সেখানে হেরে গেলে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আসে। সেখানে হেরে গেলে আপিল বিভাগে যায়। সেখানে হেরে যাওয়ার পর অর্থ পরিশোধ করে। এর মধ্যেই বছরের পর বছর সময় চলে যায়। এনবিআরের ঊর্দ্ধতন একটি সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে সিম পরিবর্তন সংক্রান্ত আগের মামলাটির শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। শিগগির এ বিষয়ে রায় দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ওই রায়ে কোন নির্দেশনা থাকলে তার আলোকে পুরোদমে কাজ শুরু করা হবে। মোবাইল ফোনের সিম হারিয়ে গেলে, চুরি বা নষ্ট হয়ে গেলে একই গ্রাহকের জন্য সিম পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের উপর নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ হয় না। কিন্তু নতুন করে সিম কিনতে গেলে গ্রাহককে ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়। বর্তমানে এই কর প্রতি সিমে একশ’ টাকা হলেও আলোচ্য সময়ে তা তিনশ’ টাকা থেকে ছয়শ’ টাকা পর্যন্ত ছিল। এনবিআর ধারণা করছে, আলোচ্য মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো নতুন সিম বিক্রি করে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য সেগুলো সিম পরিবর্তন বা রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে দেখিয়েছে। সূত্র জানায়, বৃহত্ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনার কামরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একজন প্রতিনিধি, মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের একজন, তিন মোবাইল ফোন কোম্পানির তিনজন প্রতিনিধিও রয়েছেন। কমিটির সদস্য সচিব এলটিইউ-ভ্যাটের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বদরুজ্জামান মুন্সি। কমিটি ইতিমধ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। কী উপায়ে সিম রিপ্লেসমেন্টের ইস্যুটি তদন্ত করা হবে—কমিটি তা নির্ধারণ করবে। এর আগে ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের সিম পরিবর্তনের তথ্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করে এনবিআর। পরীক্ষায় মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সরবরাহ করা সিম পরিবর্তনের বেশিরভাগ তথ্যই সঠিক ছিল না বলে কমিটি সিদ্ধান্ত দেয়। এবারও এনবিআর একই পদ্ধতিতে সিম পরীক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো তাতে একমত নয় বলে জানা গেছে। বৃহত্ করদাতা ইউনিটের একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, সিম পরিবর্তন সংক্রান্ত সব নথি পরীক্ষা করা কার্যত অসম্ভব। তবে এক্ষেত্রে ২০০৫ সালের এনবিআরের একটি আদেশের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই আদেশে বলা হয়েছে, যে কোন কারণে মোবাইল ফোনের নম্বর অপরিবর্তিত রেখে সিম পরিবর্তন করতে হলে এর তথ্য-প্রমাণাদি প্রতি মাসে এনবিআরকে দিতে হবে। এটি হলো মোবাইল সেবা গ্রহণকারীর সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিপত্র/এসএএফ ও সিম পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য বা এসআরএফ। কিন্তু ফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলো তা দেয়নি। এ কারণে এনবিআর ওই আদেশের বলে দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করলেও তা আইনগতভাবে সিদ্ধ হবে। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নথিপত্র দৈবচয়নের ভিত্তিতে নিয়ে তা পরীক্ষা করা হবে। এর মধ্যে যতগুলো ভুল পাওয়া যাবে, তার উপর শতকরা হিসাবে এনবিআরের দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে।
যোগাযোগ করা হলে এমটবের মহাসচিব টিআইএম নূরুল কবীর বলেন, নতুন করে এ তদন্তের উদ্যোগ খুবই দু:খজনক। আমরা বিস্মিত হয়েছি। আগের দাবিও ঠিক ছিল না। সেটি এখনো সুরাহা হয়নি। আমরা আমাদের বক্তব্য ইতিমধ্যে এনবিআরকে জানিয়েছি। এসব কারণে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।