কেরানীগঞ্জের পোশাক কারখানায় চলছে ‘ঈদ’
বিশেষ প্রতিনিধি: কম দামের পোশাকের জন্য কেরানীগঞ্জ জনপ্রিয়। আসছে মাসেই ঈদের বেচাবিক্রি জমে উঠবে। তাই সেখানকার পোশাকপল্লির ছোট ও মাঝারি কারখানায় দিনরাত কাজ করছেন শ্রমিকেরা। আসছে মাসেই ঈদের বেচাবিক্রি জমে উঠবে। তাই সেখানকার পোশাকপল্লির ছোট ও মাঝারি কারখানায় দিনরাত কাজ করছেন শ্রমিকেরা। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগরের হাসান রাজা খুপরির মতো দুটি ছোট্ট কক্ষ নিয়ে বাহার গার্মেন্টস। সেখানেই একের পর এক প্যান্ট সেলাই করে চলেছেন ১৬ শ্রমিক। সামনের মাসেই রোজার ঈদের বেচাবিক্রি জমে উঠবে। তাই কারখানাটিতে কাজ চলছে দিনরাত। বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা কেরানীগঞ্জের চর কালীগঞ্জে আহসান উল্লাহ চৌধুরী টাওয়ারের পঞ্চম তলায় বাহার গার্মেন্টস। গত বুধবার (২৯ মার্চ) সকালে কারখানাটিতে গিয়ে দেখা গেল, কারখানার মালিক মো. বাহার একজন শ্রমিককে নিয়ে প্যান্ট মজুতের কক্ষে কাজ করছেন। মো. বাহার জানালেন, কোরবানি থেকে রোজার ঈদ পর্যন্ত বছর হিসাব করেন তাঁরা। গতবার ৩০ হাজার প্যান্ট তৈরি করেছিলেন। এবার ৩৫ হাজার প্যান্ট তৈরি করবেন। এসব প্যান্টের অর্ধেকের বেশি ঈদের সময় বিক্রি হয়। কারখানা ভবনের নিচে তাঁর নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র থেকেই এসব প্যান্ট ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করবেন তিনি। বাহার গার্মেন্টসের মতো কেরানীগঞ্জের পোশাকপল্লির কয়েক হাজার ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানা ঈদের পোশাক তৈরিতে এখন খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এসব কারখানায় ছোটদের পোশাক, মেয়েদের সালোয়ার কামিজ, পালাজ্জো, ছেলে-মেয়ে উভয়ের জিন্স ও গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, ছেলেদের টি-শার্ট, জামা, পাঞ্জাবি, ফতুয়া ইত্যাদি তৈরি হয়। একাধিক ব্যবসায়ী জানালেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য কম দামের পোশাকের জোগান দিতে কেরানীগঞ্জ বিখ্যাত। এখানে ১১০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকায় ছোট ও বড়দের জিন্স প্যান্ট পাওয়া যায়। তবে তরুণদের জন্য ৪৫০-৬০০ টাকার জিন্সই বেশি চলে। এ ছাড়া ১১০-৩০০ টাকায় ফতুয়া, ২২০-৫৫০ টাকায় পাঞ্জাবি, ১৫০-১০০০ টাকায় শার্ট, ৩০০-৪০০ টাকায় বাচ্চাদের পোশাক, ৩০০-৮০০ টাকায় মেয়েদের সালোয়ার কামিজ পাইকারি দরে বিক্রি হয়। তাই সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা এখানে পাইকারি দরে পোশাক কিনতে আসেন। ১২ মাসই কম-বেশি ব্যবসা হয় কেরানীগঞ্জে। তবে রোজার ঈদে পোশাকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসাও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। সারা বছর যে ব্যবসা হয় তার ৬০-৭০ শতাংশই রোজার ঈদকেন্দ্রিক। সেজন্য গত কোরবানির ঈদের পর থেকেই পোশাক তৈরি শুরু করেছে কারখানাগুলো। শবে বরাতের পর বেচাবিক্রি পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে। কেরানীগঞ্জের পোশাকপল্লিতে প্রায় ২০০ মার্কেট বা বিপণিবিতান আছে। এসব মার্কেটে কতগুলো বিক্রয়কেন্দ্র ও কারখানা আছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান নেই। এমনকি দিনে কত টাকার লেনদেন হয়, তারও কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার ৬০০। বিক্রয়কেন্দ্র ৩ হাজার হতে পারে। আমাদের ধারণা, সাধারণত দিনে এক থেকে দেড় কোটি টাকার লেনদেন হয়। তবে ঈদের আগে দৈনিক লেনদেন ৭-৮ কোটি টাকা হতে পারে।’ অবশ্য কয়েকজন ব্যবসায়ী জানালেন, ছয় থেকে সাত হাজার পোশাক কারখানা আছে কেরানীগঞ্জে। বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা নয় থেকে দশ হাজারের কম হবে না। ঈদ মৌসুমে কম করে হলেও হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এখানকার বিক্রয়কেন্দ্র ও কারখানায় দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বুধবার ঘণ্টা চারেক পুরো এলাকা ঘুরে দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি বিপণিবিতানের ওপরই গড়ে উঠেছে ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানা। অধিকাংশ কারখানার আকার ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গফুট। কোনটির আকার আবার দেড় শ থেকে দু শ বর্গফুটের বেশি হবে না। আকারভেদে কারখানাগুলোতে ৪ জন থেকে শুরু করে ৪০ জন পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করেন। আহসান উল্লাহ চৌধুরী টাওয়ারে দুই বছর আগে কারখানা দিয়েছেন ইউনুস আলী। তাঁর কারখানায় বাচ্চাদের জিন্স প্যান্ট তৈরি হয়। এসব প্যান্টের পাইকারি দর ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ইউনুস আলী বলেন, ‘গত রোজায় ৭ হাজার প্যান্ট বিক্রি করেছিলাম। এবার ১০-১২ হাজার করব। আশা করছি, ভালো ব্যবসা করতে পারব।’ তিনি জানালেন, তাঁর কারখানায় ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। নকশাভেদে প্রতি প্যান্টে শ্রমিকেরা ৩০-৪০ টাকা মজুরি পান। প্যান্ট তৈরির জন্য ডেনিম কাপড়ের দাম আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে কারখানা ও দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে অনেক প্রতিযোগিতা। তা ছাড়া শ্রমিকসংকট প্রবল। সে জন্য ব্যবসার অবস্থা খুব একটা ভালো না, পেটে ভাতে চলছে, দাবি করলেন ইউনুস আলী। পূর্ব আগানগর এলাকায় আলম টাওয়ারের প্রথম চারটি তলায় শো-রুম বা বিক্রয়কেন্দ্র। পঞ্চম থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত রিফাত গার্মেন্টস, এমএস গার্মেন্টস, কবীর গার্মেন্টসসহ বেশ কটি পোশাক কারখানা। প্রতিটি কারখানায় এখন চলছে পোশাক তৈরির ধুম। এসএম গার্মেন্টস নামের কারখানাতে মেয়েদের সালোয়ার কামিজ ও স্কার্ট তৈরি হয়। কারখানার স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা অন্য শ্রমিকদের পাশাপাশি নিজেও কাজ করেন। আমরা যখন কারখানাটিতে যাই, তখন তিনি মেঝেতে বসে কাপড় কাটছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বললেন, মাসে প্রায় ১ হাজার ২০০ পিস স্কার্ট করেন তিনি। তবে শ্রমিকসংকটের কারণে তাঁর কারখানায় পাঁচটি মেশিনই ফাঁকা। না হলে আরও বেশি পোশাক তৈরি হতো। ফরহাদ ঢালী মার্কেটের ওপরে গিয়ে মাঝারি আকারের কারখানার খোঁজ মিলল। কারখানার নাম আবে জমজম গার্মেন্টস। সেখানে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট তৈরির কাজ করছেন ৪০ জন শ্রমিক। কারখানার ব্যবস্থাপক মো. পারভেজ বললেন, সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার প্যান্ট তৈরি হয় এখানে। প্রতি প্যান্টে শ্রমিকেরা গড়ে ৪১ টাকা পান। প্রতিটি প্যান্টের দাম ৩২০ থেকে ৪৮০ টাকা। তিনি বলেন, প্যান্টগুলো কারখানার মালিকের নিজস্ব দুটি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে পাইকারি বিক্রি হবে। বিপণিবিতান ঘুরে দেখা গেল, ঈদের পোশাক তৈরিতে কারখানাগুলোর ব্যস্ততা থাকলেও পাইকারি দোকানগুলোর অধিকাংশই ক্রেতাশূন্য। তাই বলে বসে নেই দোকানের কর্মচারীরা। বসে বসেই অনেকে কারখানায় তৈরি হওয়া প্যান্টের অতিরিক্ত সুতা কাটছেন। তারপর আবার সেগুলো কারখানায় ফেরত যাবে, ইস্তিরি করে মোড়কীকরণ করে গুদামে রাখা হবে। আলম টাওয়ারের আরএম গার্মেন্টস নামের বিক্রয়কেন্দ্রে ছেলেদের শার্ট বিক্রি হয়। পুরান ঢাকার উর্দু রোডের নিজস্ব কারখানায় শার্ট তৈরি হয়। মাস চারেক আগে এই পোশাকপল্লিতে বিক্রয়কেন্দ্র করেছে আরএম গার্মেন্টস। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মো. লাকী বললেন, ‘আসছে ঈদের আগে ১৫ হাজার শার্ট বিক্রি করার মতো প্রস্তুতি নিয়েছি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেরানীগঞ্জের পোশাকপল্লিতে দেশি পোশাকের পাশাপাশি চীন ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের পোশাক পাওয়া যায়। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সুবিধার্থে দুই ডজনের বেশি ব্যাংকের শাখা ও ৩০টি পরিবহন কোম্পানির শাখা আছে। এ ছাড়া কাপড়, বোতাম, সুতা, হ্যাঙ্গার, পলিব্যাগের বাজার গড়ে উঠেছে। তাই এসব পণ্য কিনতে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন হয় না ব্যবসায়ীদের। জানতে চাইলে সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম বলেন, দেশে এখনো স্বল্প আয়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাদের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি মাথায় রেখেই কেরানীগঞ্জের কারখানাগুলোতে পোশাক তৈরি হয়। তিনি আরও বলেন, সন্তোষজনক মান ও কম দামের কারণেই এখানকার পোশাকের চাহিদা সব সময়ই বেশি। প্রতিবছরই দোকানের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি নতুন নতুন কারখানাও গড়ে উঠছে।