নোয়াখালীতে মুক্তি যুদ্ধের এক বিপ্লবী সৈনিক সুবেদার শামছুল হক

IMG_20170306_115801
মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন,নোয়াখালী ব্যুরো: ১৯৭১ সালে মুক্তির সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জবাবাদিহিতার মাধ্যমে দেশ ও মানুষের প্রেমে উদ্বুদ্দ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সুবেদার শামছুল হক। ২৫ মার্চ দিবা রাত ১২টার সময় রাজারবাগ জয়দেবপুর বাউল বাশার বাড়ি থেকে মুক্তি যুদ্ধের সূচনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন সুবেদার শামছুল হক । পরে তিনি সাঙ্গিয়দের নিয়ে নরসিংদী, আশুরগঞ্জ, ভৈরব, তেলিয়াপাড়া হয়ে ভারত ভ্রমন করেন । মেজর শফিউল্যা মেখলা ৩নং সেক্টর ও মেজর খালেদ মোশারফ উলুপুর ২নং সেক্টর দায়িত্ব পালন করেন । সুবেদার শামছুল হক চাকুরি জীবনে যুদ্ধকালীন কী ভাবে দায়ীত্ব পালন করতে হয় সেই জন্যে চীন সহ বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেছিলেন । সেই সাহসী বিপ্লবী সৈনিক সুবেদার শামসুল হক দহ্মতার সাথে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল আখাউড়া কমল নগর, মনর্কোলা ও ছিলোনিয়া যুদ্ধে ১০ এপ্রিল ফেনীর মুন্সির হাট,শুভপুর ব্রিজ ও ছাগলনাইয়ায় গেরিলাযুদ্ধে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে গিয়ে বাম পাঁয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন । তৎকালীন মেজর খালেক মোশারফ তাকে বলেন হালছেড়ে দিলে হবে না মনবল নিয়ে শত্রু মুক্ত করতে হবে । আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে, তুমি ভেঙ্গে পড়লে নোয়াখালীতে যুদ্ধ করবে কে? খালেদ মোশারফের পরামর্শে আমি গুলি বিদ্ধ পায়ে কাদা মাটি দিয়ে গামছা বেঁধে পেলি,এবং আমার সাহস ফিরে পায়। সঙ্গীয়, শক্তি ও মনোবল দিয়ে ২১শে এপ্রিল ৭১সালে ইষ্ট বেঙ্গলের হাওলাদার নূর মোহাম্মদ ,রুহল আমিন,সিপাহী নূর নবী সহ ১০জন আর্মি নিয়ে হ্মিলপাড়ায় আগমন করি। সেখানে লুৎফুর রহমানের সাথে পরিচয় হয়, সুবেদার শামছুল হকের সাথে পিতাম্বরপুর, কড়িহাটি,খিলপাড়া,উলোপাড়া সহ একাধিক স্থানে গড়ে তোলা হয় একাধিক যুদ্ধের টিম তৈরী কেন্দ্র । লুৎফুর রহমানের তত্ত্যবধানে টিম তৈরী করে প্রশিহ্মনের জন্যে তাদের ভারতে পাঠানো হয়। গেরিলা যুদ্ধে শত্রুবাহিনী কে পরাজিত করতে প্রশিহ্মন শেষে সাত মেট্রিকটন অস্ত্র নিয়ে হ্মিলপাড়ায় আবার ফিরে আসেন। সেখানে সকল প্রস্তুতি পূর্বক ২০ এপ্রিল ১৮ জন আর্মি সঙ্গীয় নিয়ে এল এমজি-৩,এল এমজি-৩৪, গ্রেনেট, চাইনিজ রাইফেল সহ যুদ্ধের বিভিন্ন উপকরন নিয়ে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি বগাদিয়া প্রথম যুদ্ধ শুরু করা হয়। সেখানে এশার নামাজ পর্যন্ত তীব্র যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। সেখানে হানাদার বাহিনীর নেতা কর্নেল ও মেজর সহ অনেকে মারা যায়। আমাদের হাওলাদার নূর মোহাম্মদ, সিপাহী নূর নবী শহীদ হন। এশার নামাজের পর পরই কালিকাপুর অধ্যাপক হানিফ সাহেবের বাড়িতে কিছুহ্মন বিশ্রাম করে সকল প্রস্তুতি নিয়ে পেনাকাটা পোলে গেরিলা যুদ্ধে মুখামুখি হই। তখন ৮০জন সাহসি আর্মি সাথে ছিলেন, এ সময় শতশত স্থানীয় লোক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা প্রদান করে। চার জন সুবেদার সহ ১৩ জুলাই জিরতলি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুর রব,আবু তাহের সঙ্গীদের নিয়ে নাজিরপুর গ্রামের মামুন মাষ্টার বাড়ির উত্তর পাশে প্রধান সড়কের পাশে রবির রাইছমিল রানীর পুকুর পাড়ে মিত্র বাহিনির উপর হামলা চালানো হয়। পরে আগষ্ট মাসের ১ম সাপ্তাহে
বেগমগঞ্জ থানার ভিতরে থাকা পাঞ্জাবীদের উপর গ্রেনেট বিস্ফোরন করা হয় । ১৩ আগষ্ট ছিলোনিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন, ১৪আগষ্ট ফেনী ছিলোনিয়া একবাড়িতে থাকা কালিন জয়নাল হাজারি ও কয়েক জন ছাত্র দেখা করে জানান,বসুরহাট বালিকা উচ্চ বিদবালয়ে পাঞ্জাবীরা বহু নিরীহ বাঙালী নারী ও পুরুষের উপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে, তখন সুবেদার শামছুল হক তৎকালীন ছাত্র জয়নাল হাজারি সহ কয়েক জন ছাত্রকে পারার্মশ দিলেন,মহিপাল সহ বিভিন্ন স্থানে রাতে টেলিফোনের তার বিচ্ছিন্ন করে দিতে,তারা সবাই একইকন্ঠে তার কাটার প্রতিশ্রুতি দিলেন। রাতে তার কাটা হলে ফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মিত্র বাহিনির,সেই সময় রাত ২টায় ১২জন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে এক হাজার গ্রনেট সহ বসুরহাট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অভিযান চালান। ভোর রাতে বিদ্যালয়ের পাশদিয়ে ডোবায় ডুব দিবে উত্তর দিকে সরে আসে। চারদিকে গোলাগোলির শব্দ, যুদ্ধ আরো তীব্রতর হতে থাকে,স্থানীরা দু হাত উপরে তুলে প্রার্থনা করতে থাকে। জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধের হাল ছাড়েনি সুবেদার শামছুল হক, মেজর খালেদ মোশারফের দিক নির্দেশনায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং আরো এগিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হও ।
পরে লহ্মীপুর হয়ে চন্দ্রগঞ্জ আশার পর লুৎফুর রহমান, অলি উল্যা,গাজী আমিন উল্যা, আব্দুর রব চেয়ারম্যান , নূর মোহাম্মদ, খিলপাড়ার রুহুল আমিন,চৌমুহনীর আব্দুল লতিফ মাষ্টার,আমানতপুরের এম এ মতিন, টি এসটি আহম্মদ উল্যা,আমিশা পাড়ার নূর নবী চৌধুরী,জামাল আহমেদ,ইউসুফ মিয়া,মাইজদীর মো:জামাল উদ্দীন, নাম না জানা অনেকে যুদ্ধের উপকরণ নিয়ে আমাদের সাথে প্রস্তুত ছিলেন।
সুবেদার শামছুল হক ৭বার ভারত আগমনের দহ্মতা দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে বেতারে শোনা জাচ্ছে,এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,যুদ্ধ আরো বেগমান হলো।
চন্দ্রগঞ্জ অবস্থান কালে খবর আসে লহ্মীপুর দালাল বাজার ব্রিজের নিকট পঞ্জাবীরা সমাগত হচ্ছে। সেখানে পরিচয় হলো তৎকালীন খালেদ মোহাম্মদ এমপির সাথে, জামা ও লুঙ্গী তৈরী করে নিয়ে আসে বাঙ্গালী মুক্তি যোদ্ধা দের জন্যে , সেগুলো গ্রহন না করে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন,যেসব মা বোন এর কাপড় নেই তাদের দিতে বলেন সুবেদার শামছুল হক। এখন যুদ্ধে এগিয়ে যাবার সকলের অংগীকার। ৪টি মাইন নিয়ে ১৬ জনের টিম শত্রু মোকাবেলায় প্রস্তুত। দেখা যাচ্ছে ধিরে ধিরে পাঞ্জাবীদে গাড়ী আসছে ,এক একটি গাড়ী থেকে ২০-৩০জন নামছে। শতধিক পাঞ্জাব জড়ো হওয়ার পর মেশিন গান চালিয়ে পাঞ্জাবীদের কে এক সাথে আমারা মারতে সহ্ম্যম হই। ভারতে যাওয়ার পর ফিরে আসেন সুবেদার শামছুল হক, ৬ডিসেম্বর চৌমুহনী টেকনিক্যাল হাই স্কুলে চৌমুহনী পৌর চেয়ারম্যান ছেরাজুল হক বিএ ও তার মেয়ে কে পাঞ্জাবীরা নির্মম নির্যাতন করার খবর পেয়ে আমি আমার টিম নিয়ে উপস্থীত হই, পাঞ্জাবীরা আত্মসমর্পন করলে তাদের আমি মুক্ত করি ছেরাজুল হক বিএ সহ অনেক কে। রেলওয়ে ষ্টেশান দিকে এগিয়ে গেলাম টিম নিয়ে, যাওয়ার পর এগিয়ে আসে রেল মাষ্টার বললেন তাদের বিশ্রাম কহ্মে পাঞ্জবীদের রেখে যাওয়া অনেক গুলো টাকার বস্তা, পরে দশ বস্তা টাকা উদ্ধার করা হলো। সেই টাকার বস্তাগুলো রেল লাইনের উপর ফেলে পাম্প থেকে পেট্রোল এনে টাকার উপর আগুন জালিয়ে দেয়া হলো। সুবেদার শামছুল হক ৮ ডিসেম্বর মাইজদী রেলাইনে সুংগা মুকবুল কে নিয়ে বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে আর্মি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া হয়, তৎকালীন ডি সি মঞ্জুরুল হক দায়ীত্বে ছিলেন। ভারতীয় বিগ্রেডিয়ার বার্গার যুদ্ধকালীন অস্ত্রে দেখাশুনা করতেন এবং অস্ত্র ভান্ডারের নিয়ন্ত্রনে ছিলেন গাজী আমিন উল্লাহ,পাঞ্জাবীরা তাকে মারার জন্যে খুজতে থাকে। কিছুতে তাকে খুজে বের করতে পরেনি মিত্রবাহিনী, সুবেদার শামছুল হক বলেন,
নোয়াখালী যুদ্ধ চলাকালীন সময় গাজী আমিন উল্যা চেয়ে অন্য কারো বেশী অবদান নেই।তিনি ১৭বার ভারত গিয়ে ছিলেন ও একটানা ৮-৯দিন বস্ত্রহীন অবস্থায় পানীতে ডুবে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে ,তিনি রাজনীতি করতে গিয়ে চৌমুহনীতে কোটি কোটি টাকার সম্পদ হারিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধা সংঘঠক নুরুল হক সহেব গাজী আমিন উল্যা সাহেব কে পছন্দ করতেন ও তার নিকটে বেশি সময় কাটাতেন। সুবেদার শামছুল হক এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান,মেজর শফিউল্যা,মেজর হায়দর এর অধিনস্ত যুদ্ধ সহ বিভিন্ন দায়ীত্ব পালন করেন। তিনি যুদ্ধ চলাকালীন সময় নোয়াখালীতে মোট ১৭৫জন আর্মি অংশ নিয়েছে বলে জানান, সুবেদার শামছুল হক নোয়াখালী জেলার জয়াগ ইউনিয়নের উলুপাড়া গ্রামে পিতা সুলতান মিয়া পাটোয়ারি ,মাতা দুদনেহার বিবি, মুসলিম পরিবারের ১৯২৪ সালে ৭ জানুয়ারী জন্ম গ্রহন করেন। দুই ভাই ৮ বোনের মধ্যে ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড়, শিহ্মা জীবন শেষ করে তিনি ১৯৪৯সালে সৈনিক পদে অংশ গ্রহন করেন। ১৯৮২ সালে ৪এপ্রিল তিনি অবসর গ্রহন করেন। তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। তিনি বলেন আমার চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই, সাত হাজার ৩৯০টাকার চাকুরীর পেনষন ও মুক্তি যোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হলেও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তিনি পাননি। ঈমানের সাথে আমার যেন মৃত্যু শুধু এই দোয়া করবেন আমার জন্যে। তিনি এই প্রতিবেদক এর কাছে মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র মোতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, উলুপাড়া শুধু আমার এলাকা নয়, আমি যুদ্ধ করেছি দেশ ও জাতির জন্যে অনেকে অনেক কিছু করেছে আমি কিছুই করতে পারি নাই। বর্তামান স্পিকার ড:শিরিন শারমিন চৌধুরীর বাড়ি এই এলাকায়, কিন্তু আমার একটি আহ্মেপ একমাত্র কলেজ রোড়টি এলাকা বাসীর যাতায়াতের উপযোগী দেখতে পাইনি, জন দূর্ভোগ চরম আকার ধারন করেছে। আমি এলাকাবাসীর হয়ে ৫ কিলোমিটার রাস্তার পরিত্যক্ত অবস্থা থেকে পাকা করে যাতায়াত উপযোগী দেখে যেতে পারি তবে এটাই হবে আমার যুদ্ধের অংশগ্রহনের স্বার্থকতা, তিনি সড়কটির উন্নয়নে জন নেত্রী শেখ হাসিনা সহ সংশ্লিষ্ট সকলের হস্তহ্মেপ কামনা করেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *