মণিরামপুরে কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে হরিলুট ॥ কাজে যাননা এক-তৃতাংশ শ্রমিক
আনোয়ার হোসেন,মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি: যশোরের মণিরামপুরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের ৪০ দিনের কাজ ব্যাপক অনিয়ম,দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে। কাজ শুরুর আগ থেকেই এই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতিতে জড়িত আছেন ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বরসহ পিআইও অফিসও। ফলে এই প্রকল্পের প্রায় ১ কোটি টাকা অনাসায়ে ঠুকছে জড়িতদের পকেটে। এদিকে এসব অনিয়মের অভিযোগ উপজেলা প্রশাসনের হাতে এই পর্যন্ত ৮ টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছে খেদাপাড়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান ও ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড সদস্য তাইজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। চেয়ারম্যান মুজিবর কর্মসূচির কাজ ফেলে পাঁচ দিন ধরে নদী থেকে অবৈধভাবে বালি তোলাচ্ছেন। আর মেম্বর মিলন প্রকল্পের দরিদ্র ১১ জনের ভূয়া নাম তালিকায় দিয়ে তাদের সই জাল করে সেই টাকা পকেটস্থ করছেন বলে অভিযোগ। তাছাড়া কর্মসংস্থানের অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রশাসনের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ এসেছে অহরহ। তবে এসব অভিযোগের তদন্ত হলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যৎসামান্য। সূত্রমতে, প্রায় ৩ কোটি ১৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা ব্যয়ে উপজেলার ১৭ টি ইউনিয়নে ১৩৩ টি কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে ৩ হাজার ৯২৮ জন শ্রমিকের তালিকা নিয়ে কাজ শুরু হয় চলতি বছরের ৪ মার্চ। তার আগে প্রণয়ন করা হয়েছে কাজের দরিদ্র শ্রমিকদের নামের তালিকা। এই তালিকায় রয়েছে সীমাহীন অনিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, পিআইও অফিসের যোগসাজসে পূর্বের কার্ডধারী অনেক লোককে বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে নতুন লোক ঢুকিয়েছে স্থানীয় মেম্বর চেয়ারম্যানরা। তাছাড়া নীতিমালা উপেক্ষা করে তালিকায় স্থান পেয়েছে মেম্বরদের স্ত্রী,সন্তান এমনকি স্বামীর নামও। কোন কোন ইউনিয়নে তালিকায় নাম রয়েছে আবার গ্রাম পুলিশ সদস্যদের স্বজনদের। তালিকায় রয়েছে নামে বেনামে পিআইও অফিসের স্বজনদের নামও। আবার নাম রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদেরও। যাদের কেউ কোনদিন কাজে যোগ দেননি। ফলে শুরু থেকেই এরা কাজে অনুপস্থিত থাকেলেও মেয়াদ অন্তর টাকা তুলেছেন। যার সবটাই রয়েছে পিআইও অফিসের গোছরে। অভিযোগ রয়েছে,১৩৩ টি প্রকল্পের প্রতিটিতে এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক কাজে থাকছেন অনুপস্থিত। আবার কোথাও কোথাও অনুপস্থিতের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। কর্মসংস্থান প্রকল্পের তালিকাসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে খেদাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবর গত পাঁচ দিন ধরে কর্মসংস্থান কাজের শ্রমিকদের দিয়ে ইউনিয়নের মাহমুদকাটি বিশ্বাসপাড়া এলাকায় হরিহর নদী হতে বালি তোলাচ্ছেন বলে অভিযোগ। চেয়ারম্যান এই বালি স্থানীয় টলি চালক ফারুককে দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পার করছেন। তাছাড়া ইউনিয়নের ৭ নং (মাহমুদকাটি-কদমবাড়িয়া) ওয়ার্ডের মেম্বর তাইজুল ইসলাম মিলনের বিরুদ্ধে কাজে যাননা এমন ১১ জন শ্রমিকের নাম তালিকায় বসিয়ে তাদের সহি জাল করে টাকা উত্তোলন করে আতœসাৎ এর অভিযোগে ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তার নামের এক ব্যক্তি লিখিত অভিযোগ করেছেন। আব্দুস সাত্তারের পক্ষে গত সোমবার দুপুরে রবিউল ইসলাম নামের এক যুবক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট অভিযোগটি জমা দেন। ওই ওয়ার্ডে ৩৬ জনের তালিকার মধ্যে কাজে আসেন মাত্র ২০-২২ জন। বাকি ১৬ জন সব সময় থাকছেন অনুপস্থিত। তারপরও কাজের ২০ দিনের মাথায় এরা হাজিরার টাকা তুলেছেন পুরোটাই। অভিযোগ রয়েছে মেম্বর মিলন নীয়মনীতির কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে নিজের ছেলে,ভাই ও বেয়াই এর নাম তালিকায় দিয়েছেন। বিষয়টি পিআইও অফিসের সহকারী প্রকৌশলী গোলাম সরোয়ারকে জানিয়েও কোন ফল পাননি বলে অভিযোগ রবিউলের। তবে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মেম্বর মিলন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে এটা জানতে পেরে মেম্বরকে দৌঁড়ঝাপ দিতে দেখা গেছে। আর অভিযুক্ত চেয়ারম্যান মুজিবরকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অপরদিকে কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে অনিয়ম হয়েছে রোহিতা ইউনিয়নে খোলাখুলিভাবে। এখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে গ্রামপুলিশের সদস্যরা একজন সদস্যের নাম ভূয়া দিয়ে টাকা তুলেছেন। তাছাড়া ইউনিয়নের সব ওয়ার্ডে কাজে অনুপস্থিত থাকছেন কোথাও অর্ধেক বা তিনভাগের একভাগ। ইউনয়নের কোদলাপাড়া ওয়ার্ডে ২৬ জনের মধ্যে কাজে আসেন ১৩ জন। যদিও ওই ওয়ার্ডের মেম্বর মনিরুল ১৯ জন হাজির হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন,‘কি করব ভাই। পিআইও অফিসের কবির ইউনিয়নের অপর ওয়ার্ডের লোক। সে চেয়ারম্যানের কাছে তার একটি লোকের নাম দেয়ার দাবি করেন। তখন চেয়ারম্যান তাকে আমার ওয়ার্ডে এনে ঢুকিয়েছেন।’ তাছাড়া পিআইও অফিসের গোলাম সরোয়ার ইউনিয়ন পরিষদে বসে এসব তালিকা দেখে তার বৈধতা দিয়েছেন বলে দাবি করেন মেম্বর মনিরুল।’ একই ইউনিয়নের রোহিতা ওয়ার্ডের মেম্বর মোহিতুলও কাজে লোক কম অনুপস্থিতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন,‘আমার ওয়ার্ডে ৩০ জনের মধ্যে ২০ জন কাজ করে।’ মেম্বর মোহিতুল আরও বলেন,‘যারা কাজে আসে না তার মধ্যে ওয়ার্ডের সভাপতি-সেক্রেটারি ও চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি রয়েছেন।’ কাশিমনগর ইউনিয়নের ইত্যা ওয়ার্ডের মেম্বর শহিদুল তার স্ত্রীর নাম তালিকায় দিয়ে টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ। হরিদাসকাটি ইউনিয়নের চান্দুয়ায় ২৯ জনের মধ্যে ৯ জন অনুপস্থিতের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের সহকারী প্রকৌশলী গোলাম সরোয়ারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,এসব কাজে অনিয়মতো টুকটাক হবেই। সব ওয়ার্ডে লোক দুই একজন করে অনুপস্থিত থাকতে পারে তবে অত বেশি না।’ তবে তাকে জড়িয়ে আনিত অভিযোগের বিষয়গুলো সত্য নয় বলে গোলাম সরোয়ার দাবি করেছেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইয়ারুল হকের কাছে কাজের নীয়মনীতি ও তালিকা চাইতে গেলে তিনি বলেন,‘তালিকা নিতে হলে ইউএনও স্যারের কাছে লিখিত আবেদন করতে হবে। ’ তাছাড়া তিনি এই বিষয়ে রিপোর্ট না করার জন্যও অনুরোধ করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ অতুল মন্ডল জানান,কর্মসূচির কাজের ব্যাপারে অনেক মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। তাছাড়া লিখিত অভিযোগ পেয়েছি ৮ টা। সব ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।