এমপি লিটন হত্যা অজ্ঞাতনামা আসামীর মামলায় খুনি সনাক্তের সাফল্য পুলিশের
মোশাররফ হোসেন বুলু, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা : গাইবান্ধা-১ সুন্দরগঞ্জ আসনের আ’লীগ দলীয় সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় খুনি সনাক্তসহ গ্রেফতার করে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন পুলিশ। সক্ষম হয়েছেন খুনের কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে।
গত বছরের শেষ দিন থার্টি ফাস্ট নাইটের প্রথম প্রহরে (সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা) নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের গুলিতে গুরুতর আহত হন এমপি লিটন। দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান তিনি। মৃত্যু সংবাদ মহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হয় এ খুনের ঘটনা। খুনিরা এমপিকে গুলি করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরদিন নতুন বছরের প্রথম দিন থানায় প্রথম মামলাটি দায়ের করা হয় লিটন খুনের। মামলার বাদী হন লিটনের ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী। অজ্ঞাতনামা ৫ জনকে আসামী করা হয় মামলায়। অজ্ঞাতনামা আসামী করা হলেও মামলার বর্ণনায় জামায়াত-শিবিরের প্রতি অভিযোগের তীর ছোড়া হয়। নৃশংস এ হত্যাকান্ডের পর পুলিশ প্রশাসন নড়ে-চড়ে বসে। আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে প্রশাসনের তোলপাড় শুরু হয়। আ’লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ডাকে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ খুনিদের আইনের আওতায় আনার দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়। অবরোধ ও হরতাল করাও হয়। সভা-সমাবেশে এমপি লিটন হত্যাকান্ডে জামায়াত শিবিরের সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়। প্রকৃত খুনি ধরতে চলে পুলিশের বিরামহীন অভিযান। চলে ধর-পাকড়। এমপি লিটনকে খুনের মাধ্যমে জামায়াত-শিবির পথের কাঁটা সরিয়েছে বলে ধারণা নিয়েই প্রথমে কাজ করে তদন্তকারী দল। কারণ সাংসদ লিটন সব সময়েই জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাই জামায়াত-শিবির লিটনের প্রতি ছিল ক্ষুদ্ধ। এ হত্যাকন্ডের শুরু থেকেই সরকার ও দলের পক্ষ থেকে জামায়াত শিবিরকে দায়ী করা হয়। সেই সাথে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সংশ্লিষ্টতাও খতিয়ে দেখে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, পিবিআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিরামহীন কাজ করে খুনি পাকড়াও করতে। গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে খুনির তথ্য না পাওয়ায় আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করে তদন্তকারী দল। এমপির পরিবার হতাশায় ভোগেন খুনি ধরা না পড়ায়। শুধু জামায়াত শিবিরকে নিয়েই তদন্ত না করে অন্যান্য দিক বিবেচনা করে তদন্তের আহ্বান জানানো হয় বাদীর পক্ষ থেকে। পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে। দলীয় কোন্দল ছাড়াও সাংসদে পরিবার ও স্বজনদেরও সন্দেহের মধ্যে রাখে পুলিশ। দফায় দফায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয় তদন্তকাজে। একপর্যায়ে খোজা হয় এমপির গোপন শত্রুকে। জামায়াত-শিবির ছাড়াও দলীয় কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় কোন শক্তি এ কিলিং মিশন হাতে নিতে পারে কি না তাও খতিয়ে দেখে পুলিশ। পুলিশের কর্মকান্ড সর্বমহল ও সরকারের কাছে সমালোচিত হয়। সুন্দরগঞ্জবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেন খুনি ধরা না পড়ায়। এমপি লিটনের প্রকাশ্য শত্রু ছাড়াও গোপন শত্রুর সন্ধান চালায় পুলিশ। পরবর্তী এমপি হওয়ার খায়েস কার তাও দেখা হয় খতিয়ে। খুনের তথ্য উদ্ঘাটন না হওয়ায় পুলিশের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশ ছাড়াও দেশের বাহিরে পুলিশের কর্মকান্ড প্রশংসিত হলেও লিটনের খুনি ধরা না পড়ায় পুলিশের মাঠ পর্যায় থেকে উর্ধ্বতন কর্তৃকপক্ষ ভোগেন ¯œায়ু চাপে। তদন্তকারী দল বয়ে বেড়ায় মানসিক চাপ। কিন্তু পুলিশ হাল ছাড়েননি। পুলিশের দাবী ছিল তথ্য-উপাত্ত অনেক পাওয়া গেছে যেকোন সময় খুনি ধরা পড়বে। খুনি ধরার আশাকে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে চলে পুলিশ। এমপি লিটনকে খুন করে খুনিরা পালিয়ে যায়। লিটন খুনের গডফাদার সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাপার সাবেক এমপি ডাঃ আঃ কাদের খানের ইন্ধনে খুন হওয়ার বিষয়ে কারও নজরই ছিল না। কাদের খানের খায়েস ছিল পরবর্তী এমপি হওয়ার। এমপি লিটনের সাথে কাদের খানের মতবিরোধ ছিল। এমপি লিটনের সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় উপজেলা আ’লীগের দপ্তর সম্পাদক চন্দন কুমারের। কাদের খান এই সুযোগে চন্দন কুমারকে কাছে টেনে নেন। মোট অঙ্কের টাকা দেন চন্দনকে এমপি লিটনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ দায়ের করতে। অবশেষে খুনের পরিকল্পনা করে কাদের খান। পরিকল্পনা মোতাবেক এমপি লিটনকে খুন করে কাদের খান। কিন্তু কাদের খানের আরেক পথের কাটা ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে শেষ না করলে তার এমপি হওয়ার পথ পরিস্কার নয়। তাই কাদের খান তার পথ সুগম করতে পরিকল্পনা করে শামীম পাটোয়ারীকে খুন করার। কিলারদের সাথে মোবাইল ফোনে খুনের পরিকল্পনা পুলিশের আড়ি পাতায় ধরা পড়ে। পুলিশ দেখে আশার আলো। সব দিক বিশ্লেষণ ও নিশ্চিত হয়ে কাদের খানকে রাখে নজরবন্দি করে। এরই ফাঁকে কিলারদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। কিলারদের জিজ্ঞাসাবাদে এমপি লিটনকে খুনের স্বীকারোক্তি ছাড়াও কাদের খানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। অবশেষে কাদের খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ডে নেয় তাকে। রিমান্ডের মেয়াদ শেষ না হতেই গত শনিবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় খুনের স্বীকারোক্তি দেন কাদের খান। এই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে পুলিশ তার সফলতা রক্ষা করতে পেয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামীর মামলায় এভাবে খুনি বের করতে পুলিশকে অনেক খড়-কুটো পোড়াতে হয়েছে। এদেশের পুলিশের ভাবমর্যাদা, সুনাম ধরে রেখেছে পুলিশ এমপি লিটনের খুনি সনাক্ত করে। এসাফল্য পুলিশের। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবু হায়দার মোঃ আশরাফুজ্জামান জানান, খুনি সনাক্তে আমরা সফল হয়েছি।