অনুসন্ধান প্রতিবেদন কেমিক্যাল ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি দিয়ে তৈরি হচ্ছে দুধ ॥ প্রশাসন নির্বিকার ব্যর্থ
এম এ কামাল : ভেজাল শব্দটি আমাদের প্রতিটি রন্দে রন্দের সাথে যেন একে বাওে মিশে গেছে। বর্তমানে শিশুর খাদ্যেসহ তরল দুধে ভেজালের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাজারে রং বেরঙ্গের বাহরী জার বা প্যাকেটে ভেজাল দুধ বিক্রয় হচ্ছে। এক শ্রেনীর অসাধু ব্যাবসায়ী বিভিন্ন ব্যান্ডের প্যাকেট বা জার হুবুও নকল করে এ সব দুধ বাজার জাত করছে। অনুসন্ধানে জানাযায় সাদা পানিতে নামমাত্র ননি, গুড়ো দুধ, চিনি, লবণ, খাবার সোডা ( সোডিয়াম কার্বনেট) ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি (আসেন্স) মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব নকল দুধ। এই দুধ বেশি সময় ভালো রাখতে ক্যামিকেল ব্যবহার করা হচ্ছে। পরে সেখান থেকে প্যাকেটজাত ওই বিষাক্ত তরল দুধ আকর্ষণীয় বিভিন্ন মোড়কে নামিদামি ব্রান্ডের নামে প্যাকেটজাত করে সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকারের যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে আবারো ভেজাল ও নিুমানের দুধে সয়লাব তরল দুধের বাজার। নগর জীবনে তরল দুধের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অসাধু চক্র বিষাক্ত কেমিক্যাল ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি দিয়ে তৈরি করে বিভিন্ন কোম্পানির নামে বাজারজাত করছে এসব দুধ। ফলে স্পর্শকাতর শিশুসহ জনস্বাস্থ্য হয়ে পড়েছে হুমকির সম্মুখীন। নগরবাসীর প্রোটিন ঘাটতি মেটাতে এ দুধ খাচ্ছে। কিন্তু এ দুধে প্রোটিন রয়েছে কী-না তা নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। নগরীর বিভিন্ন দোকানে ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে প্রায় সাত ধরনের দুধ পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, মিল্কভিটা, প্রান, আড়ং, আরডি ও মাকর্সসহ বিভিন্ন ধরনের তরল দুধ। কিন্তু এসব দুধের একটির স্বাধের সাথে আরেকটির কোন মিল নেই। ফলে অনেকের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। সব দুধের স্বাদ তো একই থাকার কথা কিন্তু কেন একটির সাথে আরেকটির মিল নেই। জানা গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন মণে মণে দুধ কিনে আনে ঘোষেরা (দুধ ব্যবসায়ী)। সেই দুধ থেকে প্রথমে ননি আলাদা করা হয়। এরপর ওই দুধ থেকে ছানা তৈরি হয়। ছানা তুলে নিলে যে পানি থাকে, তা হলো নকল দুধের মূল উপাদান পানিতে প্রথমে লোহা কাটার জন্য ব্যবহƒত কাটিং ওয়েল (যা হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হয়) প্রতি লিটারে দুই ফোঁটা হারে মেশানো হয়। এতে ছানার পানি পুরোপুরি সাদা রং ধারণ করে। সেই সাদা পানিতে নামমাত্র ননি, গুড়ো দুধ, চিনি, লবণ, খাবার সোডা ( সোডিয়াম কার্বনেট) ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি (আসেন্স) মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব নকল দুধ। এই দুধ বেশি সময় ভালো রাখতে এতে মেশানো হয় পার-অক্সাইড ও ফরমালিন। একজন দুধ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের জানান, এক মণ দুধ তৈরিতে আড়াই থেকে তিন কেজি ননি, এক কেজি চিনি এবং পরিমাণ মত খাবার সোডা ব্যবহার করেতে হয়। দেশে সংগৃহীত মোট দুধের পরিমাণের সিংহভাগই পাবনা-সিরাজগঞ্জ,যশোর,খুলনা থেকে সংগ্রহের মাধ্যমে তরল অবস্থায় ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পক্রিয়াজাত করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। দুগ্ধখামারে তরল দুধ সংগ্রহের পর থেকে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই একশ্রেণীর অসাধু ঘোষ ও মধ্যস্বত্বভোগী দুর্বৃত্তচক্র তরল দুধের সঙ্গে নানা তিকারক কেমিক্যাল মিশ্রণ করে স্থানীয় বেসরকারি বিভিন্ন দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে সরববাহ করছে। বিভিন্ন চিলিং সেন্টারে সংগ্রহ করা ওইসব বিষাক্ত তরল দুধ শীতলীকরণ করে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। পরে সেখান থেকে প্যাকেটজাত ওই বিষাক্ত তরল দুধ আকর্ষণীয় বিভিন্ন মোড়কে নামিদামি ব্রান্ডের নামে প্যাকেটজাত করে সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। দুধ ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, খাঁটি দুধ বিক্রি করে আশানুরূপ মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। তাই তরল দুধ ব্যবসায়ীদের অনেকেই খাবার পানির সঙ্গে ফরমালিন, কাটিং ওয়েল, পার অক্সাইড, খাইসোডা ও দুধের ননী মিশিয়ে নকল ভেজাল দুধ তৈরি করে বিক্রি করছেন। এতে প্রতি ৩৭ লিটার খাবার পানিতে ৩ লিটার দুধের ননী, ৫০ গ্রাম খাইসোডা, কয়েক চামচ পার অক্সাইড, ফরমালিন ও কাটিং ওয়েল মিশিয়ে ১ ক্যান (৪০লিটার) নকল ভেজাল দুধ তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে যেসব তরল দুধ পাওয়া যায়, তার ৯৮ ভাগই ভেজাল ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক তিকর। যে প্লাস্টিক প্যাকেটে তরল দুধ রাখা হয়, তা তরল দুধসহ কোন খাদ্যসামগ্রী রাখার পে নিরাপদ নয়। খাদ্যসামগ্রী সংরণের উপযোগী প্লাস্টিক প্যাকেটের মূল্য বেশি হওয়ায় মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা নিুমানের ও বিষাক্ত প্লাস্টিকে তরল দুধসহ খাদ্যসামগ্রী প্যাকেটজাত করছে। চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের বিষাক্ত ও ভেজাল তরল দুধ সেবনে কিডনি ও লিভার নষ্ট হওয়ার আশংকা বেশি। শিশু ও মায়েদের জন্য এই দুধ আরো তিকর। এই ধরনের ভেজাল ও বিষাক্ত দুধ সেবনে গর্ভবতী মায়েদের গর্ভপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে। একই সঙ্গে গর্ভস্থ সন্তানের জীবনের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। বেশি দিন সেবনে কিডনী নষ্ট হতে পাবে। বলাবাহুল্য, উপরের খবরটি উদ্বেগজনক। পুষ্টিকর খাবার হিসেবে কিনে অনেকে প্রতারিত হচ্ছে, পুষ্টির বদলে গ্রহণ করছে ক্ষতিকর উপাদান। জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর দুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ কর্তব্য আছে। সরকারের উচিত উপযুক্ত তদারকি ও তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু সরকারের বাইরেও দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব আছে। দেশের বাজারে ভালো মানের দুধ উৎপাদন করে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে। এখন তাদের ভালো দুধের মধ্যেও যদি কিছু অংশ ভেজাল হয় তবে তাদের পুরো সুনামটিরই মৃত্যু হবে। মূলত ভেজালের সাথে আপোসহীন এমন কোন দুধ কোম্পানি নেই। দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রত্যেক কোম্পানিই কিছু ভেজাল ও নকল দুধ সংগ্রহ করে বাজার ধরে রাখছে। মূলত সাধারণে জানতে পারলে এতে তাদের পুরো সুনামই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আগে দুধে পানি দেয়া হতো। এরপর জানা গেল পানিতে দুধ মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে। যে কারণে দুধ থেকে টেংরা মাছকেও লাফিয়ে পড়তে দেখা গেছে। এখন জানা যাচ্ছে দুধই নয়, পানির সাথে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে নকল ও বিষাক্ত দুধ। এক কথায় ডিজিটাল ভাবে দুধে ভেজল হচ্ছে। এত হীন ভেজাল প্রবণতা দূর করতে প্রশাসন যেমন নির্বিকার তেমনিই ব্যর্থ।