খুলনা মক্কী মসজিদের ইমাম মুফতি রশিদ আহমাদ ১১ কোটি টাকা হজম করতে কাগজপত্র নিয়ে দৌড়ঝাঁপ খুলনায় এহসান সোসাইটির নামে ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ গোলাম রহমান ও রশীদ আহমাদ এর খপ্পরে ১০ সহস্রাধিক গ্রাহক
অপরাধ তথ্যচিত্র ডেস্ক : খুলনায় ‘এহসান সোসাইটি’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে খুলনার দু’জন মুফতী (হুজুর) গোলাম রহমান ও রশিদ আহমাদ নিরীহ ও সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে এ পরিমাণ অর্থ লুটে নিয়েছেন। মোটা অংকের লভ্যাংশের লোভ দেখিয়ে ১০ সহস্রাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু লাভের গুড়ে বালি দিয়ে উল্লিখিত দু’ মুফতী তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে এসব অর্থ লুটে নিয়ে প্রতারণায় লিপ্ত হয়েছেন। বহাল তবিয়তে রয়েছেন তারা।
এদিকে, প্রতিষ্ঠানের খুলনায় মাঠ পর্যায়ে কর্মরত ৮৫ জন কর্মী (যারা গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানে জমা করেছেন) চরম বিপাকে পড়েছেন। যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও মাদরাসার শিক্ষক। দু’ মুফতী কর্তৃক আত্মসাতকৃত টাকা গ্রাহকরা ফেরত না পেয়ে কর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। এ কারণে অনেককেই তাদের কর্মস্থল থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বর্তমানে কর্মীদের কেউ কেউ আত্মগোপনে এবং অন্যরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ফলে গ্রাহকদের অর্থ উদ্ধারে তারা আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। এছাড়া গ্রাহকদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ এবং গুরুতর অসুস্থ হলেও তাদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এহসান সোসাইটি নামক একটি প্রতিষ্ঠান সুদমুক্ত এবং শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালনার কথা বলে খুলনা নগরীর পাওয়ার হাউজ মোড় সংলগ্ন ১৭২ নম্বর শের-এ বাংলা রোডে অফিস খুলে বসে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া হয় ঢাকার উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের (বাড়ি-৩৯, রোড-৭/ডি) রোজ গার্ডেন (দ্বিতীয় তলা)। ২০০৪ সাল থেকে খুলনায় এর কার্যক্রম শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির খুলনা বিভাগীয় পরিচালক নগরীর দারুল উলুম মাদরাসার বহিষ্কৃত শিক্ষক মুফতী গোলাম রহমান এবং খুলনা জেলার সমন্বয়কারী ডালমিল মোড়স্থ মক্কি মসজিদের ইমাম মুফতী রশিদ আহমাদ। সঙ্গে যোগ দেন গোলাম রহমানের ভাগ্নে খুলনা শাখার ম্যানেজার রবিউল ইসলাম। এরা নিজেদের পরিচিতি, ইমেজ ও ধর্মীয় অনুভুতিকে পুঁজি করে খুলনার সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে একাধিক সেমিনার ও মতবিনিময় সভা করেন। যাতে নগরীর বিভিন্ন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও মাদরাসার শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে ইসলামী অর্থনীতির দোহাই দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করতে প্রলোভন দেখানো হয়। অনেকটা সহজ-সরল ইমাম-মুয়াজ্জিন ও মাদরাসার শিক্ষকরা তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে গ্রাহক সংগ্রহে নেমে পড়েন। এভাবে তারা গ্রাহকদের বুঝিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ করে কোটি কোটি টাকা জমা করান। সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র খুলনা মহানগরী ও দিঘলিয়া উপজেলা এলাকা থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে ১০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা এলাকা থেকে এহসান সোসাইটিতে মাসিক সঞ্চয় বাবদ ৩ কোটি টাকা, খালিশপুর এলাকা থেকে দেড় কোটি টাকা এবং দিঘলিয়া উপজেলা থেকে ৪০ লাখসহ মোট ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া রিয়েল এস্টেটের (জমির ব্যবসা) নামে মাসিক মুনাফার নামে আরও সংগ্রহ করা হয় ৬ কোটি টাকা। এভাবে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমানত হিসেবে দু’টি খাতে মোট ১০ কোটি ৯০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, খুলনায় কাজ শুরুর পর প্রথম দিকে গ্রাহকদের কিছু কিছু লভ্যাংশ লোক দেখানো হিসেবে পরিশোধ করা হলেও ২০১৪ সাল থেকে এ টাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতারণা বুঝতে পেরে এরপর থেকে গ্রাহকরা তাদের জমানো অর্থ ফেরত চাইলে মুফতী গোলাম রহমান ও রশিদ আহমাদ নানা টালবাহানা শুরু করেন। আশ্রয় নেন নানা ছলচাতুরিরও। কৌশলের অংশ হিসেবে রশিদ আহমাদ দায়ভার এড়াতে প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগের নাটক করেন। একইভাবে গোলাম রহমানও কিছু জানেন না বলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।
প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী মুফতী মুনিরুজ্জামান অভিযোগ করেন, মুফতী গোলাম রহমানের কথায় বিশ্বাস করে তিনি প্রায় দেড় শতাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ১২ লক্ষাধিক টাকা সংগ্রহ করে জমা দেন। এখন তারা এসব টাকা ফেরত না দেওয়ায় গ্রাহকরা তাকে চাপ দিচ্ছেন। এমনকি মসজিদ থেকে তার চাকরিও চলে গেছে। অনেক গ্রাহক ভয়ভীতিও প্রদর্শন করছেন। এতে তিনি চরম নিরাপত্তাহীনতা এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন।
মাঠকর্মী মাওলানা মুশাহিদুল্লাহ বলেন, তিনি ৪২ জন গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা সংগ্রহ করেছেন। মাঠকর্মী মাওলানা আবুজর বলেন তিনিও প্রায় ১৪ লাখ টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছেন। কিন্তু গোলাম রহমান ও রশিদ আহমাদ টাকা না দেওয়ায় তারা গ্রাহকদেরও টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, মাঠকর্মী মাওলানা ফারুক হোসেন প্রায় ৭শ’ গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা সংগ্রহ করেন। এ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গ্রাহকদের চাপের মুখে বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মুফতী গোলাম রহমান এহসান সোসাইটির কেন্দ্রীয় শরীয়াহ কাউন্সিলের সহ-সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি নগরীর বাগমারাস্থ মারকাযুল ফিকহিল ইসলামী মাদরাসার পরিচালক। জেলা সমন্বয়কারী মুফতী রশিদ আহমাদ নগরীর ডালমিল মোড়স্থ মক্কি মসজিদের ইমাম। তিনি এহসান সোসাইটির খুলনা জেলার সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি মাসে তিনি কমিশন বাবদ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা সম্মানি নিয়েছেন। এ অর্থে তিনি বটিয়াঘাটার কৃষ্ণনগর এলাকায় ১৬ কাঠা জমির ওপর বিশাল ভবন নির্মাণ করেছেন।
প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ কাউন্সিলের সভাপতি চট্টগ্রামের হাটহাজারী রইস-দারুল ইফতা আল জামিয়াতুল আহলিয়া মইনুল ইসলাম মাদরাসার মুফতী জসিম উদ্দিন, সহ-সভাপতি ফেণির জামিয়া হুসাইনিয়া ওলামা বাজার মাদরাসার নূরুল ইসলাম আদীব, সেক্রেটারী চট্টগ্রামের পটিয়ার আল-জামিয়া আল ইসলামিয়ার তত্ত্বাবধায়ক মুফতী শামসুদ্দিন জিয়া এবং সদস্য বগুড়ার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া কাসিমুল উলুম জামিল মাদরাসার মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী, সিলেট কাজীর বাজারের জামিয়া মাদানিয়া ইসলামিয়ার মুফতী শফিকুর রহমান ও বরিশালের জামিয়া ইসলামিয়া মাহমুদিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ওবাইদুর রহমান মাহবুব। এছাড়া পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হলেন আল্লামা আবু তাহের নদভী, সহ-সভাপতি মাওলানা মশিউর রহমান, সম্পাদক মাওলানা কাজী ফজলুল করিম, সহ-সম্পাদক মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, সদস্য মুফতী শামসুদ্দিন জিয়া, ড. খোন্দকার আ.ন.ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাফেজ মাওলানা রবিউল ইসলাম, মুফতী রুহুল আমিন যশোরী ও কাজী মিনহাজ উদ্দিন। অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে মুফতী গোলাম রহমান বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। যা যথাযথভাবেই ফেরত দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি জানান, এ অর্থ দিয়ে ঢাকায় জমি ও বাড়ি কেনা হয়েছে। যা এই মুহূর্তে বিক্রি করা যাচ্ছে না। বিক্রি হলেই টাকা ফেরত দেওয়া হবে বলেও দাবি করেন তিনি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক খুলনার মহাব্যবস্থাপক মো. রবিউল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, এভাবে সাধারণ গ্রাহকের টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করার কোন সুযোগ নেই। কেউ এ ধরণের কাজে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। (তদন্ত চলছে বিস্তারিত আগামীতে চোখ রাখুন)