পাবনা ফরিদপু রাজবাড়ির ইতিকথাঃ
মো:আহসান হাবীব লেলিন : তাড়াশের জমিদার বনওয়ারী লাল রায় নদীবেষ্টিত বনবেষ্টিত ছায়া সুনিবিড় আম্রকাননের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার নাম অনুসারে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম বনওয়ারী নগর। তার আগে জায়গাটির নাম ছিল ফরিদপুর। হযরত শাহ শেখ ফরিদ (রঃ) নাম অনুসারে ফরিদপুরের নামকরণ করা হয়। হযরত শাহ শেখ ফরিদ (রঃ) এর মাজার উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে বড়াল নদীর ওপারে পার ফরিদপুর গ্রামে রয়েছে। মাজারের নিকট একটি মসজিদও রয়েছে। জমিদার বনমালী রায় বাহাদুর নিজের নামে গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেই সমাপ্ত করেননি, তাড়াশের জমিদার বাড়ির অনুরূপ আরও একটি বাড়ি তৈরি করেন। চারদিকে দীঘিবেষ্টিত একটি মাত্র প্রবেশদ্বার সংরক্ষিত ছায়াঘেরা আমবাগানের মধ্যে মনোরম এ বাড়িটিই ফরিদপুর রাজবাড়ি বা বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি নামে পরিচিত। রাজবাড়িটি এখন উপজেলা পরিষদ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে আরও একটি জনশ্রুতি আছে তবে তার ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি পাওয়া যায়নি। তত্কালে জমিদার তাড়াশ থেকে করতোয়া, গুমানী, বড়াল ও চিকনাই নদীপথে এসে ইছামতি নদী দিয়ে পাবনা সদরে খাজনা দিতে যেতেন। যাত্রাপথে একবার তিনি বড়াল নদীর পাড়ে এ সুন্দর ছায়াঘেরা স্থানে যাত্রা বিরতি করে বিশ্রাম করেন। সে সময় তিনি একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখে মুগ্ধ বা বিস্মিত হন। ব্যাঙ সাপকে ভক্ষণ করছে। এতে তিনি বুঝতে পারেন জায়গাটি ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ হিন্দু শাস্ত্রমতে সাপ মনসাদেবীর প্রতিমূর্তি। তিনি জায়গাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে বাড়ি তৈরি করেন এবং আস্তে আস্তে তাড়াশ থেকে বনওয়ারী নগরে তার জমিদারীর সকল কার্যক্রম স্থানান্তর করেন।জমিদার বনওয়ারী লাল রায় বাহাদুর বৃহত্তর পাবনা জেলার বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার দেব চড়িয়া গ্রামের বাসুদেব তালুকদার ওরফে নারায়ণদেব চৌধুরীর বংশধর। বাসুদেব তালুকদার ওরফে নারায়ণদেব চৌধুরী তত্কালে ঢাকার নবাব ইসলাম খাঁর অধীনে চাকরি করতেন। নবাব তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে “চৌধুরীরাই তাড়াশ” নামক সম্পত্তি তাকে জায়গীর দান করেন এবং রায় চৌধুরী উপাধী প্রদান করেন। তত্কালে পরগনা কাটার মহল্লা রাজশাহীর সাঁতৈলের রাজার জমিদারী ছিল। এর দু’শ মৌজা নিয়ে এতাড়াশ জমিদারী সৃষ্টি হয়। এটা ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগের কথা।
বাসুদেব রায়ের দুই পুত্র। বড় জয়কৃষ্ণ রায় চৌধুরী ও ছোট রামনাথ রায় চৌধুরী। উভয়ই ঢাকার নবাব সরকারের চাকরি করে প্রচুর অর্থবিত্তের অধিকারী হন। বড় জয়কৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সাত পুত্র ছিল। এরা হলো- রাজারাম, গঙ্গারাম, ঘনশ্যাম, রামদেব, বলরাম, হরিরাম ও রামরাম রায়। এদের মধ্যে রামদেব, বলরাম ও রামরাম ছাড়া কারও বংশবৃদ্ধি হয়নি। বাসুদেব রায় চৌধুরীর ছোট ছেলে রামনাথ রায় চৌধুরী ও ঢাকার নবাব সরকারের চাকরি করে বিত্তশালী হন। তার দুইপুত্র রামগোপাল রায় ও রামহরি রায়। বাসুদেব রায় চৌধুরীর বড় ছেলে জয়কৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সাত পুত্রের মধ্যে বলরাম রায় পঞ্চম পুত্র বাঙ্গালার সুবাদার আজিমশ্মানে দেওয়ানে কাজ করতেন। তিনি প্রকৃত অর্থবিত্তের মালিক হয়ে রাজকার্য পরিত্যাগ পূর্বক পৈত্রিক বিষয়াদি দেখাশোনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। তার তিন পুত্র রঘুরাম, হরিহাম ও জগন্নাথ রায়। বড় রঘুরাম রায়ের দুই পুত্র। রামচন্দ রায় ও রামকেশর রায়। রামচন্দ রায়ের তিন পুত্র রামরুদ্র রায়, রামলোচন রায় ও রামসুন্দর রায়। প্রথম দু’জন নিঃসন্তান। রামসুন্দর রায়ের পুত্র কৃষ্ণ সুন্দর এবং কৃষ্ণ সুন্দর রায়ের পুত্র গৌরসুন্দর রায় অপুত্রক থাকায় বনওয়ারী লালকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন। বনওয়ারী লাল রায়ের দুই পত্নী ছিলেন। তাদের কারও সন্তানাদি না থাকায় রঘুনাথ রায়ের ভাই হরিনাথ রায়ের বংশের বনমালী রায়কে, বনওয়ারী লাল রায়ের প্রথমা স্ত্রী পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে বনমালী রায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮২ সালে দত্তক পিতা বনওয়ারী লাল রায়ের মৃত্যুর পর বনমালী রায় তার বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। পিতা-পুত্র উভয়ই ধার্মিক, বিদ্যানুরাগী ও প্রজাহিতৈষী ছিলেন। তারা উভয়ই প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত বলে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। বনওয়ারী লাল রায় সে সময় এক লাখ টাকা ব্যয়ে সিরাজগঞ্জ বনওয়ারী লাল হাই স্কুল (বিএল হাই স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পাবনা জেলা জজকোর্টের পশ্চিম পাশে ইছামতি নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ করেন। তিনি প্রজাদের জলকষ্ট দূর করার জন্য তাড়াশ ও বনওয়ারী নগর রাজবাড়ি বেষ্টন করে দীঘি খনন করেন এছাড়া বনওয়ারী নগরে আরও একটি দীঘি খনন করেন। বনওয়ারী নগর সিবিপি উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মুখে দীঘিটির নাম দুধ সাগর। ব্যবসা ভিত্তিক মাছ চাষের আগে দীঘিটির পানি ছিল স্বচ্ছ ও সুন্দর। তিনি মারা যাবার পর তার পুত্র বনমালী রায়ও তার বাবার ন্যায় প্রজাদের শিক্ষা বিস্তারে তাড়াশ ও বনওয়ারী নগরে করনেশন বনমালী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় বা সিবিপি উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১২ সালে) হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া পাবনা বনমালী ইনস্টিটিউট, টমসন হল, ইলিয়ট শিল্প বিদ্যালয়, হাসপাতাল, টাউন হল, দুর্ভিক্ষ ভাণ্ডার, জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বিজ্ঞানাগার নির্মাণের জন্য এবং যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ৫০হাজার টাকা দান করেন। ১৮৯৪ সালে ইংরেজ সরকার তার দানের প্রশংসা করে একটি পত্র দেন এবং তাকে “রায় বাহাদুর” উপাধী প্রদান করেন।
বনমালী রায় বাহাদুর শেষ জীবনে নবদ্বীপ ধামে বাস করতেন। তিনি গৌরাঙ্গের ভক্ত ছিলেন। তিনি অনেক প্রতিষ্ঠানকে মাসিক বা বার্ষিক সাহায্য করতেন। তিনি দীন দুঃখী ও অন্ধ অচলদের অন্ন, বস্ত্র, ওষুধ, অর্থদান করতেন। তিনি পাবনা জেলার শ্রেষ্ঠ জমিদার ও বরেন্দ কায়স্ত্র সমাজের জননায়ক ছিলেন। বাত্সরিক ৬০ হাজার টাকা আয়ের সম্পত্তি তিনি কূলদেবতার জন্য দান করেন।