সুন্দরবনে চোরা শিকারিরা বাঘের অবাধ বিচরণে বাধা
মনির হোসেন, মংলা (বাগেরহাট) : বনদস্যু ও চোরা শিকারিরা বাঘের অবাধ বিচরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৬ বছরে বনজীবী, চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের হাতে ৫২টি বাঘ মারা পড়েছে। এর মধ্যে বাগেরহাট অংশে মারা পড়েছে ১৯টি। বাকিগুলো খুলনা ও সাতক্ষীরা অংশে। চোরা শিকারিদের পাশাপাশি বনদস্যুরাও তাদের পেশা পরিবর্তন করে অধিক মুনাফার আশায় এখন বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ, চামড়া, হাড় পাচারে জড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমেই চলেছে। এসব কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এখন হুমকির মুখে। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে। ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল এই সুন্দরবনকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। এখানে এক সময়ে সাড়ে ৪০০-৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিরূপ পরিবেশ, চোরা শিকারিদের হামলা ও লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় জনরোষের শিকার হয়ে দিন দিন কমেই চলেছে সুন্দরবনের রক্ষা কবজ হিসেবে খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই প্রকাশিত ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা জরিপ অনুয়ায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে এখন দাঁড়িয়েছে ১০৬টিতে। অথচ ২০০৪ সালে বন বিভাগ এনএনডিপির সহায়তায় প্রথমবারের মতো বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল ৪৪০টি। ২০০৬ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করে এর সংখ্যা নির্ধারণ করে ২০০টি। গত ১১ বছরে বাঘের সংখ্যা কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের বাঘ ও সম্পদ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বনবিভাগও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ইতিমধ্যে বাঘসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় গোটা সুন্দরবন জুড়ে স্মার্টপ্রেট্রোলিং নামের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সার্বক্ষণিক পাহারা চলছে। তিনি আরও বলেন, গত এক মাস ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বাচ্চাসহ বাঘিনীদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। সুন্দরবনে খুব সহজেই বাঘের দেখা মিলছে। এই অবস্থা আগে কখনোই দেখা যায়নি। বর্তমানে বাঘের বসবাসের জন্য সুন্দরবনে অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান করেছে। পরিবেশবিদদের মতে, সুন্দরবনের বাঘ কমে যাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনও অনেকাংশে দায়ী। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে। অন্যদিকে ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর এ কারণে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের স্থান ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। কারণ, সিডর ও আইলায় নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি বনের ভেতর প্রবেশ করে আর বের হতে পারছে না। এতে বনের মিষ্টি পানির পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টি পানির সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরা শিকারিদের টার্গেটে সুন্দরবনের বাঘ। বিদেশে এই চামড়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, গুলি করে বাঘ হত্যা করে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার করে। সুন্দরবন গবেষক অধ্যাপক শাহ আলম ফরাজি বলেন, সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের যে সিন্ডিকেটগুলো রয়েছে তাদের অনেকে বাঘের চামড়া ও হাড়গোড়সহ বিভিন্ন সময় র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের হাতে আটক হলেও আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে পুনরায় একই পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। তাই কঠোর আইনের মাধ্যমে এখনই যদি এ চোরা শিকারিদের ঠেকানো না যায় তবে অচিরেই সুন্দরবন থেকে বাঘ হারিয়ে যাবে।