একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় সাপাহারে ঐতিহ্যবাহি জবই বিল পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা
নয়ন বাবু, সাপাহার (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলায় অবস্থিত প্রায় এক হাজার আয়তনের ঐতিহ্যবাহী “জবই” বিলকে আকর্ষণীয় পর্র্র্র্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা, মৎস্য সম্পদের সমাহার এবং কৃষি উৎপাদনশীল এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যায় কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো এখন একনেকে’র অনুমোদন হওয়া অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পগুলো একনেকে অনুমোদনলাভ করলে বিলসহ এর চারপাশে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নতসহ এলাকার চিত্র পাল্টে যাবে বলে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন।
সাপাহার উপজেলার মানুষের বিনোদনে তেমন কোন জায়গা না থাকায় এখানকার মানুষ জবই বিলের বিশাল রুপালী জলরাশি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দয্য বিশেষ দুই ঈদে সময় কাটাতে তাঁরা এই বিলে গিয়ে নৌকা বাইচ দেখে আনন্দ উল¬াস করে থাকেন। বৃহৎ এই প্রকল্পটি পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হলে এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র অতিথিশালা, বিলের জলের উপর ভ্রমনের জন্য স্পীডবোর্টসহ শিশু কিশোরদের আনন্দ বিনোদনের নানা ব্যবস্থা থাকবে।
জবই বিল মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মো. বকুল জানান, প্রায় ১ হাজার একর আয়তনের বিশাল ও ঐতিহ্যবাহী জবই বিলের সংস্কার ও খননের অভাবে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে এর আয়োতন প্রায় তিন গুণ হয়ে যায়। বিলুপ্ত প্রজাতির বোয়াল, চিতল, আইড়, পাবদা, টেংরা, খলিশা, চাপিলা, গাগরসহ প্রভৃতি মাছে ভরপুর। বিলের মৎস্য প্রকল্পের আওতায় ৭৯৯ মৎস্যজীবী রয়েছেন। এই মৎস্যজীবীদের উপর তাদের পরিবারে প্রায় ৩ হাজার সদস্য জীবিকা নিবাহ করে আসেন। বিলটি আগে কখনও কোন খনন কাজ না হওয়ায় উজান (ভারত) থেকে পলিমাটি ও পাড় এলাকার মাটি ধসে গিয়ে বিলটির এখন প্রায় ভরাট অবস্থা। এছাড়াও বছরের প্রায় তিন/চার মাস পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বিলের উপর নির্ভর অধিকাংশ মৎস্যজীবীদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়।
জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী এই বিলটি উত্তরে ভারতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশের সাপাহার উপজেলাকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দক্ষিণে পুণর্ভবা নদীতে মিলিত হয়েছে। বিলটির প্রকৃত নাম হচ্ছে “দামুর মাহিল” বিল। জবই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পরবর্তীতে মানুষের মুখে মুখে এই বিলের নামকরণ হয়েছে জবই বিল। সরকারী রেকর্ড অনুযায়ী এই বিলের আয়তন প্রায় ১ হাজার একর। কিন্তু বর্ষাকালে দু’ক’ল ছাপিয়ে এর আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে হয় প্রায় ৩ হাজার একর। অতীতে বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক মাছে ভরা থাকত এই বিল। শীত কালে সুদুর সাইবেরীয়া থেকে অসংখ্য অতিথি পাখী আসত এখানে। রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থান হতে অনেক পাখী শিকারীরা এই বিলে আসতেন পাখী শিকার করতে। সে সময় সারা দেশের মত এ অঞ্চলের মানুষও ছিল মাছে-ভাতে বাঙালী।
১৯৮৬/৮৭ সাল থেকে সরকারী নীতিমালার আওতায় খাজনার মাধ্যমে এলাকার মৎস্যজীবিদের মাঝে ইজারা প্রদানের যে ব্যবস্থা চালু ছিল।
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার দেশে “জাল যার জলা তার” নীতি ঘোষণা করায় এলাকাবাসী যার যার (জনসাধারণ) ইচ্ছামত ওই বিল হতে পোনা মাছসহ সব ধরনের মাছ নির্বিচারে নিধন করে বিলটিকে মাছ শূন্য করে ফেলে।
পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকারের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারী এক সফরে সাপাহারে এলে বিভিন্ন উন্নয়নের পাশা পাশি এলাকার মৎস্যজীবিদের ভাগ্যান্নয়নে ৩ কোটি ৫৫ লক্ষ্য টাকা ব্যয়ে সরকারী ভাবে এই বিলটিকে একটি বৃহৎ মৎস্য প্রকল্প হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। এই প্রকল্পের আওতায় বিলের দু’পাশের লোকজনের যাতায়াত ব্যবস্থাকে সহজতর করতে বাঁধ নির্মাণ, এক কিলোমিটার এপ্রোচ সড়ক এবং এই সড়কে ২শ’ মিটার একটি সেতু নির্মাণ করা হয়।
সে অনুযায়ী সে সময় এলাকার প্রায় দেড় হাজার মৎস্যজীবীদের একটি তালিকা তৈরি করে ২০০০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মাসে প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষামূলক ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিভিন্ন প্রজাতির পোনামাছ ওই বিলে অবমুক্ত করা হয়।
২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের কারণে মৎস্যজীবীদের ভাগ্যোন্নয়নে গড়া বৃহৎ এই মৎস্য প্রকল্পটি আবারও “জাল যার জলা তার” নীতি ঘোষণা করায় ভেস্তে হয়ে যায় । ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতার পালাবদলে ভাগ্য খুলে যায় এখনকার
মৎস্যজীবীদের। আওয়ামীলীগ সরকারি সহযোগিতায় অভয়াশ্রম, মা মাছ নিধন বন্ধ, মাছের পোনা অবমুক্ত, মৎস্যজীবীদের নিয়ে সমিতি গঠনের ফলে দেখা দেয় বিলে মাছ । তারপর থেকেই এই বিলে মাছের উৎপাদন বেড়ে যায়। মৌসুমে হাজার হাজার টন মাছ উৎপাদন করে বিল পাড়ের ৭৯৯ জন মৎস্যজীবিদের সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
বর্তমানে সাপাহার উপজেলার এই জবই বিলের মাছ সাড়া দেশ জুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এই বিলে সারা বছর প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয় বিশালাকৃতির শোল, বোয়াল, আইড়, পাবদা, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এসব মাছ নওগাঁ জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়েও ঢাকার কাওরান বাজার, টাউন হল মার্কেট সহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রিয় হচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, এই বিলের সৌন্দয্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে তুলতে গৃহিত ৪২ কোটি টাকার প্রকল্পে রয়েছে মূলত: একটি রেগুলেটর স্টীম (স্লুইচ) গেট, বিলের মুল জলাধারে পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণ করে রাখার জন্য পুরো বিল এলাকায় খনন কাজ, বাঁধ নির্মাণ এবং প্রটেকশন ওয়াল নির্মাণ।
স্থানীয় ও মৎসজীবিরা জানান, সরকারের বৃহৎ এই প্রকল্পটি সুষ্ঠ ভাবে সমাপ্ত হলে পুরো বিল এলাকাটি একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত, বিল হতে সেচ কাজের মাধ্যমে ব্যাপক ফসল উৎপাদনের কারণে এলাকায় সবুজের সমারোহ বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও বিল হতে লাখ লাখ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। সে সাথে জবই বিলসহ বিল পাড়ের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রাই পাল্টে যাবে। অপরদিকে উপজেলার কয়েক হাজার পরিবারের মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নওগাঁ রিজিওন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক চৌধুরী জানিয়েছেন, বর্তমানে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্ত্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিলের মধ্যে এলএলপি প্রকল্প গ্রহণ করে হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমি সেচের আওতায় এনে পুরোদমে ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এতে করে এলাকার কৃষকরা অতীতে সেচ কাজে যে খরচ হতো তার এক তৃতীয়াংশ অর্থ খরচ করেই তাদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলতে পারছেন। এই কর্মসূচীর আওতায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই বিলে ৮টি এল এল পি প্রকল্পে ৩২০ হেক্টর বিঘা জমিতে বোরো মওসুমে চাষাবাদ করেছেন।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্ন কর্ত্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ রেজাউল করিম জানান, এ ছাড়া আরোও ৯টি প্রকল্পের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: কামরুজ্জামান জানান, রাজশাহী বিভাগীয় একটি প্রকল্প “বরেন্দ্র মৎস্য চাষ” প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে জবই বিলে যোগাযোগের উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। এতে জবই বিল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে অন্য দিকে মৎস্যজীবীদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক বাবু সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, জবই বিলের উন্নয়ন, বিলের চারপাশের মৎস্যজীবিদের উন্নয়ন করে স্থানীয়ভাবে মাছের চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যত্র মাছ রপ্তানী করার উদ্দেশ্যে বিল খননসহ বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হলে পরবর্তীতে সরকার ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাশ করা হয়। বর্তমানে এই প্রকল্পগুলো প¬্যানিং কমিশনে রয়েছে। তিনি আশা করেন অচিরেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বিলে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।