শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত মংলা বন্দরে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা বেড়েই চলেছে
মংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি : মংলা বন্দরে শুল্ক ফাঁকি, ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি, জাল কাগজ তৈরি করে পণ্য খালাস আর কন্টেইনার থেকে পণ্য চুরির ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন পর ঘুরে দাঁড়ানো মংলা বন্দরের ইমেজ সংকট সৃষ্টি করতে একটি চক্র নেপথ্যে থেকে এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মংলা কাস্টম হাউসের কমিশনার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, কাজের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কর ফাঁকি প্রচেষ্টার কারণে মংলা কাস্টম হাউসে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ, আর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৮ শতাংশ। সূত্র জানায়, গত ১১ জানুয়ারি ঢাকার জিগাতলার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খান ইন্টারন্যাশনাল ৪০ ফুটের ৫টি কন্টেইনার বোঝাই বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে। কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষা করে ঘোষণার বাইরে (ঞবধ ঃধনরষ, সধমহবঃরপ পধঃপয, যরহমবং, ফৎধবিৎ ষড়পশ, ফড়ড়ৎ মঁধৎফ [সধমহবঃ] বফমরহম এই সকল) পণ্য পাওয়া যায়। চারটি কন্টেইনারে প্রায় ২ মেট্রিক টন অতিরিক্ত পণ্য পাওয়া যায়। এই আমদানিকারকের পণ্য খালাসের জন্য সিএন্ডএফ এজেন্ট নিযুক্ত ছিলেন মেসার্স বিএনবি শিপিং এন্ড ট্রেডিং লি:। সিএন্ডএফ প্রভাবশালী হওয়ায় শুল্ক বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করে দ্রুত শুল্কায়ন করে প্রায় ১৬ লাখ ২১ হাজার ৭৪৮ দশমিক ৬৮ টাকা কর নির্ধারণ করা হয়। এই শুল্কায়নে সহকারী কমিশনার (জেটি পরীক্ষণ) ও রাজস্ব কর্মকর্তার যৌথ তত্ত্বাবধানে এই কায়িক পরীক্ষা করে শুল্কায়ন করা হয়েছিল। কন্টেইনারগুলো বন্দর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে জতীয় রাজম্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দল চালানটি আটক করে এ বছরের ২৭ জানুয়ারি পুনঃকায়িক পরীক্ষায়ণ করে। সেই পরীক্ষায়ণে কোড পরিবর্তন করে শুল্ক ফাঁকি, ওজনের তারতম্যসহ নানা অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়। পরে আবার পুনঃপরীক্ষায়ণ করে নতুন করে শুল্ক ধার্য হয় ২৩ লাখ ২১ হাজার ৭৪৮ দশমিক ৬৮ টাকা। একই সাথে আমদানিকারককে ব্যক্তিগত জরিমানা করা হয়। একইভাবে ঢাকার বিসমিল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল ৫ কন্টেইনার বিভিন্ন পণ্য একই সিএন্ডএফ এজেন্ট ছাড় করে নেওয়ার মুহূর্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আটক করে পুনঃকায়িক পরীক্ষা চালায়। এখানেও অসাধু শুল্ক কর্মকর্তা আর সিএন্ডএফ এজেন্ট মিলে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৬৩ দশমিক ১৮ টাকা রাজস্ব ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়। খুলনার একটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গত বছর ঘোষণার অতিরিক্ত ৩১ হাজার টন পণ্য আমদানি করে। বিষয়টি মিডিয়াই প্রকাশ করে তারা পরে জরিমানাসহ ৪ কোটি টাকা বেশি কর দিয়ে পণ্য খালাস করে। মংলা কাস্টম হাউসের কমিশনার ড. মোহাম্মদ আল আমিন প্রামাণিক উল্লেখিত রাজস্ব ফাঁকি ও ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানির কথা স্বীকার করে বলেন, কায়িক পরীক্ষার টিমের তিন সদস্যকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. পারভেজ রেজা, মুনসুর রহমানসহ তিনজনের কর্তব্য অবহেলা ও রাজস্ব ফাঁকির সহায়তার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে জতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার রিও ট্রেড হাউজ, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২ ইউনিট গাড়ি আমদানির জন্য এলসি খোলে। এই গাড়ি মংলা বন্দরে আসার পর তা খালাসের জন্য সিএন্ডএফ এজেন্ট লায়লা ট্রেডিং কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই গাড়ির বিপরীতে ২৯ লাখ ৭৪ হাজার ১৭৩ দশমিক ৮০ টাকা ট্যাক্স ধার্য করা হয়। পরবর্তীতে এই টাকা ব্যাংকে জমার জাল জালিয়াতির রশিদ তৈরি করে সিএন্ডএফ এজেন্ট গাড়ি বন্দর থেকে খালাস করে নিয়ে যায়। গত বছর ২৮ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি ধরা পড়ে। সিএন্ডএফ এজেন্ট লায়লা ট্রেডিং কোম্পানি প্রথমে বিষয়টি আমদানিকারকের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যান। পরে গেট পাসে সিএন্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধির স্বাক্ষর শনাক্তের পর ফাঁকি দেওয়া কর পুনরায় জমা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও বিষয়টির আজও রাজস্ব আদায় হয়নি। একই সময় একই আমদানিকারক এবং একই সিএন্ডএফ এজেন্ট ৩টি গাড়ি আমদানি করে মোট ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৩৭ টাকা জমার জাল জালিয়াতির রশিদ তৈরি করে বন্দর থেকে গাড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে সিএন্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের ভুল স্বীকার করে রাজস্ব জমা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। এ ব্যাপারে সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মংলা কাস্টম হাউস দুর্নীতি দমন কমিশনে পত্র দিয়েছেন। ইতোপূর্বে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি মংলা বন্দরে আমদানি করে রাজস্ব জমার ক্ষেত্রে জালিয়াতি করে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ফাঁকি দিয়ে গাড়ি নিয়ে যায়। পরে ঢাকার বিআরটিএতে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করার জন্য কাগজপত্র জমা দেয়। ঢাকা বিআরটিএ’র যেহেতু ২ কোটি টাকার ওপর রাজস্ব আদায় হয়েছে, তাই যাচাই করতে মংলা কাস্টম হাউজকে পত্র দেয়। তখনই শনাক্ত করা হয় ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার কাগজপত্র জাল। বিআরটিএর সূত্র ধরে মংলা কাস্টমস হাউস এই জালিয়াতির ঘটনায় ঢাকার কাফরুল থানায় এজাহার করে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেই মামলার কোনো আসামি ধরা পড়েনি। আদায় করা যায়নি এই রাজস্ব। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার মালিকানাধীন সিএন্ডএফ এজেন্টের প্রতিষ্ঠানগুলো এই শুল্ক ফাঁকির সাথে জড়িত। ফলে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। খুলনাস্থ মংলা কাস্টম সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুলতান হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি সবাই করে। বিধান আছে ধরা পড়লে রাজস্ব আর জরিমানা দিয়ে পরে পণ্য খালাস করতে পারবে। এতে দোষের কিছু নেই। মংলা কাস্টম হাউসের কমিশনার ড. মোহাম্মদ আল আমিন প্রামাণিক বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই হাজার ছয় শ’ ৫৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। সকল কাজের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি আগের চেয়ে কমেছে বিধায় রাজস্ব আদায় ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ একই সময় আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য ছাড়ানোর পর আমদানিকারকের কাছে এ বছর মোট ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে, যা মংলা কাস্টমস হাউসের রেকর্ড। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব ফাঁকির ঘটনায় অভিযুক্ত সিএন্ডএফ এজেন্টকে কালো তালিকা বা লাইসেন্স বাতিল করা যায় কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া শুল্ক ফাঁকির ঘটনার সাথে জড়িত শুল্ক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে এই মাসের মাঝামাঝি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি তদন্ত দল খুলনা আসছেন।