বঙ্গবন্ধুর বীর বিচ্ছু ও সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীক গোপালপুরের শহীদুল ইসলাম লালু
এ কিউ রাসেল, গোপালপুর (টাঙ্গাইল) : বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা। অনেক রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে এ মাসেই এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী খেতাবপ্রাপ্ত বীরমুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছয়শ’৭৬ জন। তার মধ্যে ৭জন রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব, ৬৮জন বীরউত্তম, একশ’৭৫জন বীরবিক্রম ও চারশ’২৬জনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেছে। এই ছয়শ’৭৬ জন খেতাবী বীরমুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বীরবিচ্ছু ও সর্বকনিষ্ঠ বীরমুক্তিযোদ্ধা হলেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরশহরের সূতীপলাশ পাড়া গ্রামের শহীদুল ইসলাম লালু। তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সে মহান স্বাধনীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়ে ছিলেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, মাতা আমিনা বেগম। তিনি তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই অত্যান্ত সাহসী ও দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন শহীদুল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোপালপুরে পাকহানাদার বাহিনী ফায়ারিং শুরু করলে স্থানীয়রা প্রাণ ভয়ে এলাকা ছাড়া শুরু করলে কিশোর শহীদুল ইসলামও স্বজনদের সঙ্গে পালিয়ে বর্তমান ধনবাড়ী উপজেলার কেরামজানী নামক স্থানে আশ্রয়নেয়। দুরন্ত লালুর সাথে কেরামজানী বাজার ও স্কুল মাঠে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচয় ঘটে। বীরমুক্তিযোদ্ধার তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার প্রস্তাব দেয়। তাদের প্রস্তাবে লালু রাজী হলে মুক্তিযোদ্ধা দলের কমান্ডার কাজী হুমায়ুন আশরাফ বাঙ্গাল ও আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী কাছে ডেকে নিয়ে ঠিকানা জানতে চায়। তারপর হতেই সে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ফুট ফরমাশ কাজে লেগে যায়। বীরমুক্তিযোদ্ধাদের চা-পানি খাওয়ানোর পাশা-পাশি মাঝে মধ্যে অস্ত্র পরিস্কারের কাজও করতেন। এ ভাবেই অস্ত্র ধরা শেখেন কিশোর শহীদুল। সপ্তাহ খানেক পর মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে ট্রেনিং করার জন্য ভারত চলে যান। ভারতে গিয়ে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিংএ অংশ গ্রহন করে অস্ত্র হিসেবে স্ট্রেনগান ও গ্রেনেড পান। আর পোশাক হিসেবে হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি ও মাথার ক্যাপ। ট্রেনিংয়ের সময় ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণকালে ব্রিগেডিয়ার সামসিং শহীদুল ইসলামের নামের সাথে লালু নামটি যুক্ত করে দেন। সেই থেকে শহিদুল ইসলামের নাম হয়ে যায় শহিদুল ইসলাম লালু। যুদ্ধের পরবর্তীতে তিনি লালু নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে ছিলেন। এই লালু ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণচলাকালীন সময়ে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় হুইসেল বাজিয়ে সব মুক্তিযোদ্ধাদেরকে লাইনে দাড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকা উঠাতেন ও নামাতেন। এই কাজের সঙ্গে তাকে সহযোগীতা করতেন শ্যামল চন্দ্র দে ওরফে ভুলু। শ্যামল চন্দ্র দে সে সময় ভোলা ভোলা নাদুস নুদুস থাকায় তিনিও ব্রিগেডিয়ার সামসিং বাবাজীর কাছ থেকে সে ভুলু নামে অখ্যায়িত হয়েছিলেন। ভারতের তুরাতে লালু স্ট্রেনগান ও গ্রেনেড বিষয়ে ভালো শিক্ষা গ্রহন করে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারের সাথে মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহন করার জন্য টাঙ্গাইলের গোপালপুরের কেরামজানীতে আসেন। শহীদুল ইসলাম লালুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো গোপালপুর থানার পাক হানাদার বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। বয়সে ছোট বলে সবার অলক্ষ্যে এ কাজ সহজে করা যাবে এবং ক্যাম্পের ভেতরে সহজে ঢুকতে পারবে, শত্র“ বলে সন্দেহও করবেনা কেউ। সে জন্য লালুকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে লালু হাফপ্যান্ট পরে বিকেল বেলা তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। থানার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। থানার গেটের সামনে বটগাছের নিচে যেতেই লালুর গ্রামের এক দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। সে তখন রাজাকারদের নিয়ে রাস্তা পাহারায়া ছিল। লালুকে দেখে জিজ্ঞাস করে ‘কিরে শহীদ এতো দিন কোথায় ছিলি?’ শহীদ উত্তর দেয়-‘ কোথায় আর যাবো চার দিকে শুধু গোলগুলি আমার ভয় লাগে তাই নানা বাড়ী গিয়ে ছিলাম’। তুই আমাদের ক্যাম্পে থেকে যা, ঐ বাংকারে পাঞ্জাবী সেনাদের চা-টা খাওয়াবি। সুযোগ হাত ছাড়া না করে প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় লালু। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুর পাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করে । এক সময় সুযোগ বুঝে সবার অগোচরে থানার ভেতরের একটি পরিত্যক্ত গ্রেনেড তিনটি রেখে তা ব্যবহারের সময় খুঁজতে থাকে। তারপর চা-পানি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চারদিকে কে কোথায় আছে তা লালু দেখে নেয়। তিনি তিনটি ব্যাংকার টাগের্ট করে নেয় যা সহজেই গ্রেনেড ফাঁটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাতে ক’জন পাক সেনা ঘায়েল হবে তার হিসাবও কষে নেন। একেক ব্যাংকারে ৫জন, ৪জন ও ৩জন করে পাক সেনা রয়েছে। তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে ব্যাংকার গুলোতে পজিশন নিয়ে আছে। লালু ছোট হবার কারনে সকলের সন্দেহের বাইরে থেকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন।
তিনি লুকিয়ে রাখা গ্রেনেড গুলো আনতে যায়। সেখানে লালু কিছুটা বিপদের সম্মুখীন হয়। গ্রেনেডের উপর শুয়ে ছিলো মস্তবড় একটা সাপ। সাপ চলে যাবার পর গ্রেনেড গুলোর সেফটিপিন খুলে দ্রুত প্রত্যেক ব্যাংকারের দিকে ছুড়ে মারেন। প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় লালুর ছুড়ে মারা গ্রেনেড গুলো। এতে তিনটি ব্যাংকারের সবাই মারা যায়। আর সে দিনই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানা সহজেই দখল করে নেয়। লালু থানা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসে। সে দিন লালু ফিরে আসতে পারবে সে ধারণা কমান্ডারদেরও ছিলোনা। সৌভাগ্য ক্রমে বেচে গিয়ে শহীদুল ইসলাম লালু মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেন। এ ছাড়া শহীদুল ইসরাম লালু গোপালপুর, ভূঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের কয়েকটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। আর অধিকাংশ সময়ে পাক বাহিনীর নজরদারীর কাজটি করতেন। তারা কোথায় অপারেশন পরিকল্পনা করে সব গোপান খবর জোগাড় করে লালু মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌছে দিতো। ছদ্মবেশ ধারণ করে অগ্রীম খবর সংগ্রহের ব্যাপারে শহীদুল ইসলাম লালুর জুড়ি ছিলো না। অনেক সময় লালুর খবরের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারের পরবর্তী প¬্যান তৈরি হতো। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে যখন টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট কাদেরিয়া বাহিনীর সকল মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিচ্ছিল, তখন শহীদুল ইসলাম লালুও তার ব্যবহৃত স্ট্রেনগানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে শহীদুল ইসলাম লালুর পিঠ থাপড়ে বলেছিলেন-‘সাব্বাস বাংলার দামাল ছেলে।’ যখন সহ যোদ্ধাদের কাছ থেকে লালুর ব্যাংকার ধ্বংসের কথা শুনলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে বলে ছিলেন-‘বীর বিচ্ছু।’ সেই ছবি দিয়ে একটি পোষ্টারও পরবর্তীতে ছাপা হয়ে ছিলো। শেখ রাসেল ও গোপালপুরের শহীদুল ইসলাম লালু এক মঞ্চে বসে ছিলেন। এই দৃশ্য পরবর্তীতে বাঘা বাঙ্গালী ছবিতে দেখানো হয়ে ছিলো। বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম লালু তার বীর প্রতীক খেতাবের কথা ১৯৯৬ সালে জানতে পারেন। এর পর শহীদুল ইসলাম লালু সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০০০, আজীবন সংবর্ধনা ২০০৩, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া কর্তৃক পুরস্কার ও অর্থিক অনুদান, মিশরের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পুরস্কার সহ আরো অনেক খেতাবে ভূষিত হয়ে ছিলেন। তারপরও মানবেতর জীবন যাপন করে চার সন্তানের জনক বঙ্গবন্ধুর বীর বিচ্ছু ও দেশের সর্ব কনিষ্ঠ বীরপ্রতীক শহীদুল ইসলাম লালু ২০০৯ সালের ২৫ মে ঢাকাস্থ মীরপুরে বাস ভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এ বীরমুক্তিযুদ্ধার মরদেহ মিরপুরেই সমাহীত করা হয়।