গোপালপুরে ৫স্কুলের শিক্ষার্থীরা অন্য স্কুলের হয়ে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে

এ কিউ রাসেল, গোপালপুর (টাঙ্গাইল) থেকে : লেখাপড়া শিখে গ্রামে ফিরে, ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জালানোর প্রত্যয় ছিলো ওদের। এজন্য সরকারের সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার বিধি অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ জমি ওয়াকফ করে দেয়। নিজ খরচে নির্মাণ করে পাকা, আধাঁ-পাকা স্কুল ভবন। প্রয়োজনীয় বেঞ্চ, টেবিল, আলমিরা, পানীয় জলের নলকূপ, স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেটসহ সব শিক্ষা সরঞ্জাম নিজ পয়সায় করে। এসবে খরচ ৩০থেকে ৪০ লাখ টাকা। খরচের পুরোটা বহনে বেগ পেতে হয় ওদের। ধৈর্যের পরীক্ষায়ও উর্ত্তীণ হতে হয়। টানা বিশ বছর বিনা বেতনে পড়াচ্ছেন হতদরিদ্র পিছিয়ে পড়া শিশুদের। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাস। দু’দশকের ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় স্কুল না থাকা দশ গ্রামের কয়েক হাজার শিশু শিক্ষার আলোয় আলোকিত। নি¤œবিত্ত পরিবারের শিশুরা এখানকার বর্ণমালায় উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি চাকুরিতে ভাগ্য বদলিয়েছে। শুধু ভাগ্য বদলায়নি ওই বিশ উদ্যমীর। সরকারি করণের প্রক্রিয়া যখন নাগালে তখন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের পারিতোষক না দেয়ায় তাদের স্বপ্ন এখন ভেস্তে যাচ্ছে। এ বর্ণনা টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হাজীপুর বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাতুটিয়া উত্তরপাড়া বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরচতিলা বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছোট শাখারিয়া বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দক্ষিণ হেমনগর বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। হাজীপুর বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিরীনা আক্তার জানান, ওই ৫শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির প্রায় দেড় হাজার শিশু পড়ালেখা করে। বিশ শিক্ষকের সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ফলাফলও ঈর্ষণীয়। বিগত ২০১২ থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ডিআরভূক্ত হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে তারা। এবারও সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য গত ৩ সেপ্টেম্বর ছাত্রছাত্রীদের যথানিয়মে রেজিস্ট্রেশন করানো হয়। নিয়মানুযায়ী সোনালী ব্যাংক লিমিটেড গোপালপুর শাখায় ফি-জমা দিয়ে ডিআরভূক্ত করে রোল নম্বর অনুযায়ী সিডির সফট কপি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে জমা দেয়া হয়। এরপর শুরু নানা টালবাহানা। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিস ওই ৫বিদ্যালয়ের নামে ডিআরভূক্তকরণে মোটা অংকের পারিতোষিক দাবি করে। আগামী বছরের শুরুতেই ভালো ফলাফলধারি বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হবে বিধায় সরকারি চাকরির খাতায় নাম উঠাতে ওই পারিতোষিক। বিনা বেতনের চাকরিতে ক্লান্ত হলেও শিক্ষকরা পারিতোষিক দিতে অস্বীকার করে। তারা স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট লিখিতভাবে সহযোগিতা চায়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস কৌশলে ঘোষণা দেয় ওইসব স্কুলের পরীক্ষার্থীরা নিজ বিদ্যালয়ের নামে ডিআরভূক্ত হয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে না। তাদেরকে অন্য স্কুলের পরীক্ষার্থী হিসাবে নতুন করে ডিআরভূক্ত হয়ে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে বলা হয়। চাতুটিয়া উত্তরপাড়া বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ জানান, শিক্ষা বিভাগের এ সিদ্ধান্তে তারা হতবাক হয়ে যায়। সুবিচার পাওয়ার আশায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। গত ২১অক্টোবর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মির্জা হাসান খসরু প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের জারি করা ১২ আগস্ট ২০১৪ তারিখের ৯৭৫ (৬৪১) নং স্মারক মূলে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে পরীক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহনের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান। কিন্তু টাঙ্গাইল জেলা ও গোপালপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস অধিদপ্তরের ওই চিঠির কোনো গুরুত্ব না দিয়ে হবে হচ্ছে করে শিক্ষকদের হয়রানি করতে থাকেন। অবশেষে গত ১৯নভেম্বর গোপালপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা কমিটির মিটিংয়ে ওই ৫ বে-সরকারি স্কুলের সকল শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাকে অন্য ৫সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসাবে দেখিয়ে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। কোমলমতি শিশুদের নিয়ে গিনিপিগ না খেলার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট ইতিপূর্বে শিক্ষকরা লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। গত রোববার থেকে শুরু হওয়া সমাপনী পরীক্ষায় ওই ৫ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাধ্যহয়ে অন্য স্কুলের পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষা দিচ্ছেন। ভূক্তভোগী শিক্ষকদের অভিযোগ, বিগত ২০১২ থেকেই নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ডিআরভূক্ত হয়ে সমাপনী পরীক্ষায় এ যাবত অংশ নিয়েছেন। শুধুমাত্র পারিতোষক না দেয়ায় ক্ষুব্দ প্রাথমিক শিক্ষা অফিস মড়ার উপর খড়ার ঘা লাগিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দলিল দস্তাবেজ স্থানীয় সাংবাদিকদের নিকট জমা দিয়ে ওই শিক্ষকরা দাবি করেন, পার্শ্ববর্তী জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার কুনাইর পাড়, দক্ষিণ আদ্রা, সিংগুরিয়া, গোলআদ্রা, ছাতারিয়া পূর্বপাড়া ও দাসেরবাড়িসহ ৬টি বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজ বিদ্যালয়ের নামে ডিআরভূক্ত করে এবার সমাপনী পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। একইভাবে মধুপুর উপজেলার আউসনারা বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব নুজহাত ইয়াসমিনের এক পত্র বলে (স্মারক নং- ৩৮.০০৮.৩৫০০.০০৯.২০১৩-৮৪০, তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১৫) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালকের নির্দেশক্রমে নিজ বিদ্যালয়ের নামে ডিআর ভূক্ত হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের সুযোগ পেয়েছে। একইভাবে সরকারি বিধি অনুযায়ী দেশজুড়ে সব বে-সরকারি বিদ্যালয় এ সুযোগ পেলেও বঞ্চিত হচ্ছে শুধু গোপালপুর উপজেলার ৫টি বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এতে ওই ৫ বে-সরকারি বিদ্যালয় এবারের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের কোনো ক্রেডিবিলিটি পাবে না। ২০১৫ সালের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ধারাবাহিকতা না থাকলে আগামীতে জাতীয়করণের সুযোগ বঞ্চিত হবে ওই ৫শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খুব সু-পরিকল্পিতভাবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এ নিন্দনীয় কাজটি করেছে বলে তাদের অভিযোগ। নিজের শ্রম, ঘাম ও অর্থে চালু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে দুই যুগ অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দুর্নীতির রাহুগ্রাসে হতাশ হয়ে পড়েছেন উদ্যমী শিক্ষকরা। হতাশার ভারে অজপাড়াগাঁয় গড়ে উঠা তৃণমূলের এসব শিক্ষাগার বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সবাই। গোপালপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসার আঞ্জুমান আরা বেগম বিথি জানান, কারো কাছে কোনো পারিতোষিক চাওয়ার অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সব কিছুই করা হয়েছে জেলা শিক্ষা অফিসারের নির্দেশমত। অপরদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এনামুল হক জানান, ওই ৫ বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সময়মত আবেদন করেনি। উপজেলা শিক্ষা কমিটি সময়মত তাদের পক্ষে কোনো কাগজপত্রও পাঠায়নি। সরকার নতুন করে আর কোনো বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল শুধু সেসব প্রতিষ্ঠানই নিজ স্কুলের নামে ডিআরভূক্ত হয়ে সমাপনী পরীক্ষা দিতে পারবে এবং জাতীয়করণের আওতায় পড়বে। তিনি পারিতোষিক না পেয়ে হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটি মিথ্যা ও বানোয়াট। সব কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে করা হয়েছে। তাহলে গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিবের (নুজহাত ইয়াসমিন) নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আউশনারা বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কিভাবে ডিআরভূক্ত করে নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দেয়ানোর ব্যবস্থা করলেন? এ প্রশ্নে তিনি জানান, বিষয়টি তার কাছেও পরিস্কার নয়। বিষয়টি জানার জন্য তিনি মহা-পরিচালকের দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন। এ বিষয়টি জানতে দু’মাস কেন লাগলো? সে বিষয়ে তিনি জানান, পরিশুদ্ধ আইন জানার জন্য দেরি হয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাসূমুর রহমান জানান, এসব নিয়মকানুন তার খুব জানা নেই। এসব নিতান্তই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *