সরকারী বিধি উপেক্ষা করে বটিয়াঘাটায় পশুর হাট ইউএনও এবং ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
মোঃ নজরুল ইসলাম(খুলনা ব্যুরো চীফ) :সরকারী গেজেট উপেক্ষা এবং উপজেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়াই বটিয়াঘাটায় কোরবানী পশুরহাট বসিয়েছে ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যান। ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্লা ও ইউএনও মু. বিল্লাহ হোসেন খান হাসিলের প্রায় ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে এলাকায় ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। এদিকে গেজেটে নিদ্ধারিত টেন্ডার কমিটির কোন সদস্য এ হাটের বিষয়টি জানেন না বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। বটিয়াঘাটার জলমা ইউনিয়নের প্রগতি স্কুল মাঠে ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে পশুর হাট বসিয়ে এ অনিয়ম ও দুর্ণীতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি না নিয়েই গত ঈদুল আজহা উপলক্ষে ইউএনও বিল্লাল হোসেন খানের উপস্থিতিতে জলমা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্যার সভাপতিত্বে প্রগতি মাধ্যমিক বিদ্যাপিঠে ২৯ আগস্ট এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জলমা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্যাকে সভাপতি এবং অন্যান্য ইউপি চেয়ারম্যান সহ স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষককে সদস্য করে পশুহাট বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। যা সম্পূর্ন সরকারী গেজেট বহি:ভূত। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্লা পশুর হাট বসানোর অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেন। এ আবেদনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু. বিল্লাল হোসেন খান মতামত প্রদান করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ২০ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে গেজেটে বর্ণিত নীতিমালা অনুসরণ করে পশুর হাট বসানোর অনুমতি প্রদান করেন। জেলা প্রশাসকের পক্ষে স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক মো: হাবিবুর রহমান খান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি প্রদান করেন ॥ চিঠিতে উল্লেখ করেন, “প্রাপ্ত আবেদন ও মতামতের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, প্রস্তাবিত গো-হাট পার্শ্ববর্তী অন্য কোন বাজারের কমান্ড এরিয়ার মধ্যে বসানো যাবে না। এসকল অস্থায়ী হাট সমূহ উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক হতে হবে। তবে উক্ত অস্থায়ী হাট ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে স্থাপন করা যাবে না। সর্বসাধারনের সুবিধা ও প্রযোজন হলে মহাসড়ক ও খেলার মাঠ, স্কুল কলেজ মাঠ ব্যতিত উন্মুক্ত স্থানের বিষয়ে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্থায়ী গো-হাট বসানোর জন্য উপজেলা পরিষদের অনুকুলে জেলা প্রশাসক মহোদয় সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। বর্ণিত হাটের আর্থিক ব্যবস্থাপনা হাট-বাজার নীতিমালা/২০১১ অনুযায়ী সম্পন্ন হবে। ইজারাদানে বিদ্যমান নীতিমালা ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্র সমূহ কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।” অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ, খেলার মাঠ,রেরলাইন ও সড়ক/মহাসড়কের সন্নিকটসহ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন স্থানে পবিত্র ঈদ-উল-আযহার সময় অস্থায়ী পশুর হাট না বসানোর জন্য নির্দেশক্রমে আবারও অনুরোধ করা হলো। বিষয়টি অতিব গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্দেশ প্রতিপালনে ব্যর্থতায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব মুহাম্মদ ইকবাল হুসাইন স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ইউএনও এসব নির্দেশনা জানা সত্বেও জলমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্লাকে দিয়ে প্রগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পশুর হাট বসিয়েছেন। এ হাট বসানোর আগে নিয়ম মোতাবেক নিদ্ধারিত টেন্ডার কমিটির সদস্যদের নিয়ে সভা করে পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে টেন্ডার আহবান করবেন। তার কিছুই না করে ইউএনও সকল আইন, বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করে হাট বসিয়েছেন। ঈদের সময় ওই গরুর হাট থেকে আদায়কৃত হাসিলের টাকা এ পর্যন্ত উপজেলা পরিষদ তহবিলে জমা হয়নি বলে উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খান জানান।
এদিকে ইউএনও বিল্লাল হোসেন খান ও চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্যা পরিষদের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা এবং বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বড় আকারে গরুর হাট বসিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা রাজস্ব আদায় করেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর -২০১১ তারিখে সরকারী হাট-বজার সমুহের ইজারা পদ্ধতি এবং আয় বন্টন সম্পর্কিত নীতিমালার ১০.২ উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যদি ঈদ বা অন্য কোন বিশেষ উপলক্ষে অস্থায়ী হাট-বাজার বসানোর প্রয়োজন পড়ে, তবে সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদ জেলা প্রশাসকের পূর্ব অনুমতি গ্রহণ করে প্রচলিত নীতিমালার বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক ইজারা প্রদান করবেন। ইজারালব্ধ অর্থের ২০ ভাগ ‘‘৭ ভুমি রাজস্ব খাতে’’ ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে ইজারা প্রদানের ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জমা দিবেন। অবশিষ্ট ৮০ ভাগ অর্থ সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদের নিজস্ব আয় হিসাবে গণ্য হবে এবং উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিলে জমা দিবে। জেলা প্রশাসক বিধি-বিধান অনুসরণপূর্বক অনুমতি দিবেন।
এব্যাপারে দরপত্র মূল্যায়ন ও ইজারা প্রদান কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান বলেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে মোবাইলে কথা বলা যাবে না। সদস্য উপজেলা কৃষি অফিসার রুবায়েত আরা দেশ প্রতিবেদককে জানান, এজেন্ডা ছাড়া একটি মিটিং-এ কিছুটা আলোচনা হয়েছিলো বলে আমার মনে পড়ে। তবে কোরবানীর গো-হাট সংক্রান্ত এজেন্ডা ভিত্তিক কোন মিটিং-এর হয়নি। হলে চিঠি পেতাম। উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা আফরুজ্জামান জানান, প্রগতি মাধ্যমিক স্কুল মাঠে গরুর হাট ইজারা সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। কোন নোটিশ বা চিঠিও পাইনি। বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী কর্মকর্তা বলতে পারবেন।
গরুর হাট কমিটির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্যা প্রতিবেদককে জানান, আমি সব বিষয়ে জ্ঞাত নই। এটা ইউএনও সাহেবের বিষয়। আমি চেয়ারম্যান এলাকার স্বার্থে কাজ করেছি। হাটের ব্যাপারে টেন্ডার হয়নি। উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় এ হাটের ব্যাপারে কথা হয়েছিলো। সে মোতাবেক ইউনিয়ন পরিষদে মিটিং করে হাট বসানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাট থেকে অর্জিত রাজস্ব উপজেলা তহবিলে জমা দেয়া হয়নি। তার কাছেও কোন টাকা নাই বলে তিনি জানান। তবে হাটের শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আর টাকা ছিলো হাট কমিটির সদস্য সচিবের কাছে। আমি এ বিষয়ে কিছু জানিনা। টাকার ব্যাপারে হাট কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বাবুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গরুর হাটের টাকা সংরক্ষনের জন্য প্রগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে ক্যাশিয়ার করা হয়েছিলো। তিনিই সকল টাকাচেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্লার কথা মত খরচ-খরচা করেছেন। আমি মাত্র একজন ডেইলি লেবার হিসেবে কাজ করেছি। আমি নিজে গরু কিনেছি সম্পূর্ন হাসিল দিয়ে। সুতরাং ওই টাকা ধরার তো প্রশ্নই আসেনা।
এব্যাপারে কমিটির ক্যাশিয়ার প্রগতি মাধ্যমিক বিদ্যাপিঠের প্রধান শিক্ষক বিমল কৃষ্ণ বৈরাগী বলেন, আমি কোন টাকা পয়সা স্পর্শ করিনি। এটা চেয়ারম্যান আর হাট কমিটির সদস্য সচিব ভালো বলতে পারেন। স্কুল মাঠে হাট বসানো যাবেনা এমন সিদ্ধান্ত আমার জানা ছিলো না। এ হাট থেকে আমার স্কুলে কোন টাকা দেয়া হয়নি। তবে তিনি বলেন হাটের অর্জিত টাকা ইউপি চেয়ারম্যান গফুর মোল্লার সাথে আলাপ আলোচনা করে বিতরণ করা হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খান বলেন, সরকারী নীতিমালা উপেক্ষা সহ জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অমান্য করে এ হাট বসানো হয়েছে। হাটের ব্যাপারে কোন প্রকার দরপত্র আহবান বা মূল্যায়ন ছাড়াই ইউএনও বিল্লাল হোসেন খান এবং জলমা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্যা প্রগতি মাধ্যমিক স্কুল মাঠে গরুর হাট ইজারা দিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় করেছেন। যা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থাৎ উপজেলা তহবিলে জমা পড়েনি। এমনকি আমার অজান্তে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে রেজুলেশন করে ওই কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমাকে এখন উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারী ও এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হাটের রাজস্বের ব্যাপারে নানা প্রশ্ন করেছেন। আমি উত্তর দিতে পারি নি। এছাড়া অস্থায়ী হাট বাজার কমিটির অন্যান্য সদস্যরাও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। এলাকার জনগণ এ অর্থের সঠিক হিসাব চাইছে।