আগামী এক দশকে বিলুপ্ত হওয়ার আশংকায় সুন্দরবনের বাঘ
মনির হোসেন, মংলা (বাগেরহাট) : আগামী এক দশকের মধ্যে সুন্দরবন হতে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাবে- এমন আশংকা এখন জনমনে। বর্তমানে যে হারে সুন্দরবনের এই বিপন্ন এবং প্রায় দুর্লভ প্রাণীটি নিধন হচ্ছে তাতে এমন কষ্টকর ও বেদনাদায়ক অথচ সর্বনাশা আশংকাটি অমুলক নয়- বরং তা’ যুক্তিসংগতই বটে। চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত বন বিভাগের কাছে ৭টি বাঘ মারা যাওয়ার হিসেব রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি বাঘই চোরা শিকারীদের নিষ্ঠুরতা ও জিঘাংসার শিকার হয়ে মারা পড়েছে। সূত্রের আশংকা চোরা শিকারীদের হাতে বছরওয়ারী বাঘ শিকারের সংখ্যা আরও বেশী হবে। কারণ দুর্গম এবং গহীন অরণ্যে বেপরোয়া এই শিকারীরা যেভাবে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাতে সংখ্যা বৃদ্ধির এই ধারণা মোটেই অমুলক নয়। শিকারীরা খুবই সংঘবদ্ধ, পারদর্শী এবং এই কাজে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ। সুতরাং শিকারের সামান্য ঘটনাই মাত্র জনসমক্ষে আসে। বাকী বেশীরভাগ পাচারের ঘটনাই থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে, ভীষন সঙ্গোপনে নিভৃতে-নিরবে। বাঘ নিধনের সংখ্যা আশংকা অনুযায়ী ক্রমবর্ধমান থাকলে ১৫ বছর নয়, সুন্দরবনের ষোল কলা পূর্ণ হতে ১০ বছরই যথেষ্ট-অভিমত বন বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তার। সূত্র জানায়, সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্যাপিং-এর মাধ্যমে সম্পাদিত সাম্প্রতিক গণনার প্রেক্ষিতে ধারণা করা হয় ১০৬টি বাঘ রয়েছে যা পূর্বের (২০০৪ সালের) পায়ের ছাপের ভিত্তিতে গণনার প্রায় এক চর্তুথাংশ। আগের গণনায় ধারণা ছিল সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি। সর্বশেষ ২০১৫ সালের গণনাকে ‘ভিত্তি’ ধরে বাঘের জন্ম-মৃত্যু হার বিশ্লেষণ দেখা যায়, যে সংখ্যায় বাঘ হত্যা বা নিধন বা মৃত্যুবরণ করছে সে তুলনায় জন্ম হার অনেক কম। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রকৃতিগতভাবেই বাঘের প্রজনন হার কম এবং ধীর। সারা বছরই বাঘ প্রজনন প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হলেও নভেম্বর হতে এপ্রিল পর্যন্ত বাঘের রিপ্রোডাকটিভ পিরিয়ড বা প্রজননকাল ধরা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্ত্রী বাঘ উর্বর থাকে মাত্র ৩ থেকে ৬ দিন। সে কারণে প্রাকৃতিকভাবে বাঘের বাচ্চা উৎপাদনের হার খুবই ধীর। তার উপর আবার সুন্দরবনে স্ত্রী বাঘের সংখ্যা বাঘের মোট সংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশের মত যা জন্ম হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ। সুতরাং জন্ম-মৃত্যুর এই ব্যবধান প্রকৃতিসম্মতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা সম্ভব না হলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে সুন্দরবনের নয়নাভিরাম এই প্রাণীটির অস্বিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা সত্যি হবে যেমনটি হয়েছে সুন্দরবনের গন্ডার এবং কুকুরী হরিণের ক্ষেত্রে।
সূত্রটি এ প্রসংগে যুক্তি দেখিয়ে বলে, ইতিমধ্যে চলতি বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত ৭টি বাঘ নিধনের তথ্য রয়েছে বন বিভাগের কাছে। সে হিসেবে নিধনের এই হার অব্যাহত থাকলে ১০৬টি বাঘ বিলুপ্ত হতে ১৫ বছরের বেশী সময় লাগার কথা নয়। যেহেতু বাঘের প্রজনন হার খুব কম এবং যেহেতু বাঘের আবাসস্থলে বা হ্যাবিটেটে মনুষ্য হস্তক্ষেপসহ অন্যান্য ঝুঁকি মাত্রাতিরিক্ত সেহেতু বিলুপ্তির সময়রেখা অবান্তর নয়। সূত্র মতে, যদি কিনা বাঘ নিধনযজ্ঞ বন্ধ করা না যায় তাহলে সুন্দরবনে বাঘ নিধনের প্রকৃত সংখ্যা যদি এর চেয়ে বেশী হয় (যা ধারণা করা হয়) তা’হলে আগামী ১০ বছরের মধ্যেই অপকর্মটি সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে যা ইতিমধ্যে হয়েছে বাঘের অপর ৪টি সাব স্পেসিস বা উপজাতির ক্ষেত্রে, যেমন-গত শতাব্দিতে বিশ্বভ্রমান্ড হতে বিলুপ্ত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার বালি টাইগার, ক্যাসপিয়ান টাইগার এবং জাভান টাইগার এবং সত্তরের দশকে সাউথ চায়নার টাইগার। সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণই বাঘ যা ‘প্যানথেরা ট্রাইগ্রিস ট্রাইগ্রিস’ সাব স্পেসিস (উপজাতির বাঘ) যা রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে বিশ্বখ্যাত। আইইউসিএন-এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী এই প্রাণটি এখন ‘ক্রিটিক্যাললি এনডেঞ্জারস স্পেসিস’ বা অতি বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম লিখিয়েছে। সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে মানুষের সীমাহীন খামখেয়ালীপনা এবং প্রকৃতির ওপর নির্লিপ্ত ও চরম নিষ্ঠুর আচরণের ধারাবাহিতায় এই ধরাধাম হতে চিরদিনেরমত প্রাণী জগতের অতিসুন্দর এই প্রাণীটি এখন যাই যাই করছে। যদিও অন্তিম মুহূর্তে বিশ্ববাসীর চৈত্যন্তে বাঘের নিভু নিভু প্রাণে কিছুটা হলেও এখন প্রাণের স্পন্দন দেখা দিয়েছে। যার ফলে ৬শ’ কোটি আদম সন্তানের এই বিশ্বভ্রমান্ডে মাত্র ৫ হাজার কিছু কম বাঘ তাদের বংশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে কিছুটা হলেও আলো দেখছে। তারপরও জ্ঞানবিজ্ঞানে এবং মনুষ্যত্বে সবচেয়ে বিজ্ঞ হিসেবে দাবিদার এই গ্রহের আদমদের করুণার ওপর প্রকৃতির অনিন্দসুন্দর এই প্রাণীটি টিকে থাকবে কিনা তা’ নির্ভর করছে।