সাতক্ষীরায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেটের বাসায় কাজের মেয়েকে বর্বরনির্যাতন ! হাসপাতালের বেডে বসে নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী বর্ননা দেন বিথী, পিতা চায় দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি
হাবিব মোফাসাল সম্পাদক : সাতক্ষীরায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট নূরুল ইসলামের বাসায় কাজের মেয়ে বর্বর নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে দেশ ব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়েছে। বুধবার বিকেলে মেয়েটি ম্যাজিস্টেট নূরুল ইসলামের ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধারের পর রাতেই ২২ ধারায় তার জবানবন্ধি রেকর্ড করা হয়েছে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট শিমুল কুমার বিশ্বাস মেয়েটির জবানবন্ধি রেকর্ড করেন। এদিকে, নির্যাতনের শিকার কাজের মেয়ে বিথীর পিতা গোলাম রসুল খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে মাগুরার শালিখা থেকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে পৌছে তার মেয়ের সাথে দেখা করেছেন। গোলাম রসুল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেয়ে বিথীর শয্যাপাশে বসে বলেছেন, আমার মেয়ের উপর যারা নির্যাতন চালিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই। কঙ্কালসার মেয়ের চেহারা দেখে তিনি বলেন, আমার মেয়ের শরীর এমন ছিল না। তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। ১ বছর ২ মাস আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। কিছুদিন আগেও আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করার জন্য সাতক্ষীরায় আসলেও মেয়ের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। দেশের প্রচলিত আইনে এই বর্বর নির্যাতনের বিচার দাবি করেন তিনি। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০ টায় সাতক্ষীরার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক লস্কর তাজুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা: রফিকুল ইসলাম মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে যান। এ সময় তাদের সামনেই নির্যাতনের শিকার বিথী সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ‘নার্সের সিট রুমে’ বেডে শুয়ে তার উপর বর্বর নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী বর্ননা করেন। মেয়েটি বলেন, ১ বছর ২ মাস আগে সাতক্ষীরা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট আদালতের পিয়ন,মেয়েটির প্রতিবেশি চাচা সাগরের মাধ্যমেই বিথীকে নিয়ে আসা হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট নূরুল ইসলামের বাসায়। মেয়েটিকে আনার পর ম্যাজিস্টেট নূরুল ইসলাম ঢাকায় তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির বাসায় পাঠিয়ে দেন। ঢাকার মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ২ নং রোডের ৬৪ নং বাড়িতে নূরুল ইসলামের শ্বশুর নুরু সাহেব ও শ্বাশুড়ি বিউটি বেগম থাকেন। ঢাকার ওই বাসায় প্রায় ১১ মাস থাকাকালীন সময়ে মেয়েটির উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ম্যাজিস্টেট নূরুল ইসলামের শ্বাশুড়ি বিউটি বেগম প্রায় হাত ,পা, মুখ বেধে নির্যাতন চালাতো। তার গায়ে গরম খুনতি ও রুটি তৈরীর গরম তাওয়া দিয়ে স্যাকা দেয়া হতো। রুটি বেলা বেলুন দিয়ে তার শরীরের অসংখ্য স্থানে পিটিয়ে জখমকরা হয়েছে। মুখে খামচে দেয়া হতো। বাথরুমে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রাখ হতো। সকালে ছোট ২ খানা রুটি এবং রাতে পঁচা পান্তা ভাত খেতে দেয়া হতো। বিউটি ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় মাছ,মাংস, পোলাও-বিরানী রান্না করলেও মেয়েটিকে তা খেতে দেয়া হতো না। দুপুরে কোন খাবার তাকে দেয়া হতো না। নির্যাতনের সময় যাতে মেয়েটি চিৎকার না করতে পারে সেজন্য তার মুখ কাপড় দিয়ে বেধে রাখা হতো। মেয়েটি তার পিতার সাথে কথা বলতে চাইলে তাকে বলতে দেয়া হতো না। ১ বছর ২ মাস একটি বারের জন্য বিথীর পরিবারের সাথে দেখা বা কথা বলতে দেয়া হয়নি। মেয়েটি বলেন, প্রায় আড়াই মাস আগে ঢাকা থেকে ম্যাজিস্টেট নূরুল ইসলাম তার সাতক্ষীরার পলাশপোলস্থ ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসে তাকে। নির্যাতনের শিকার দশ বছর বয়েসের মেয়েটির এধরণের নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ননা শুনে উপস্থিত ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক লস্কর তাজুল ইসলাম , ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা: রফিকুল ইসলামসহ সেখানে উপস্থিত সিনিয়র একাধিক সাংবাদিক , চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ সদস্য শিউরে ওঠেন।
বৃহস্পতিবার সকালে বিথীর সুচিকিৎসার জন্য সার্জারী বিভাগের চিকিৎসক ডা: শরিফুল ইসলামকে প্রধান করে ৪ সদস্যের মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমের অপর সদস্যরা হলেন, মেডিসিন বিভাগের ডা: আসাদুজ্জামান, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা: শামছুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত আরএমও ডা:ফরহাদ জামিল। গঠিত মেডিকেল টিমকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেয়েটির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে মেডিকেল রিপোর্ট দেয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা: রফিকুর ইসলাম নির্দেশ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালেই মেডিকেল টিমের সদস্যরা মেয়েটির শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন। মেডিকেল টিমের সদস্য শিশু বিশেষজ্ঞ ডা: শামছুর রহমান জানান, সকালে তিনি মেয়েটির দেখেছেন। মেয়েটির শরীরে একাধিক ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। বড় ধরনের ৪টি ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। এরমধ্যে পিঠের বামপ্রান্তেযে ক্ষতটি রয়েছে সে-টি গরম কিছু দিয়ে স্যাকা দেয়ার কারণেই দগদগে ঘা হয়েছে। কতো দিন আগের ক্ষত জানতে চাইলে ওই চিকিৎসক বলেন, পিঠে যে বার্ণ রয়েছে তা সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। অন্যান্য ক্ষত গুলো আগের বলে মনে হচ্ছে।তিনি বলেন, মেয়েটি মানষিক চাপে রয়েছে। তার মানষিক চিকিৎসাও প্রয়োজন। গঠিত মেডিকেল টিমের সদস্যরা এক সাথে বসেই মেডিকেল রিপোর্টটি তৈরী করবেন। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত জানাবেন তারা।
সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি এমদাদ শেখ জানান, মেয়েটির পিতা বৃহস্পতিবার সকালে সাতক্ষীরা পৌছে তার মেয়েকে দেখতে হাসপাতালে যান। দুপুর পর্যন্ত মেয়েটির পিতা কোন মামলা বা লিখিত অভিযোগ দেয়নি। লিখিত অভিযোগ পেলেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তিনি বলেন, বুধবার মেয়েটি উদ্ধারের পর সাতক্ষীরা সদর থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়েছে। যার জিডি নং-৯৪১।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, লোমহর্ষক এই নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে যাতে মামলা না হয় সে জন্য একটি মহল চেষ্টা চালাচ্ছে। মেয়েটির পিতা যাতে থানায় অভিযোগ না দেয় সে ব্যাপারে চলছে জোর প্রচেষ্টা।
প্রসঙ্গত. কাজের মেয়ে বীথি (১০) কে বুধবার বিকালে সাতক্ষীরার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নূরুল ইসলামের ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অসুস্থ্য অবস্থায় তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বুধবার দুপুর ১টা থেকে মেয়েটি বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ‘পানি দাও, পানি খাব’ বলে আকুতি জানালে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় তারা তাকে সাহায্য করতে পারেননি। পরে প্রতিবেশীরা বিভিন্ন স্থানে জানাজানি করলে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। এরপরও ঘন্টা দেড়েক পুলিশকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে সাতক্ষীরা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র সাহা, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নম্বর-১ শিমুল কুমার বিশ্বাস, সাতক্ষীরা সদর এএসপি সার্কেল আনোয়ার সাঈদসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা এলে ঘরের দরজা খুলে দেওয়া হয়। এসময় শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। তার গায়ে পোড়া, ছ্যাকা এবং আঘাতের ৩০টিরও বেশী চিহ্ন রয়েছে। তবে কাজের মেয়ে বীথি ( ১০) তার ওপর কোন ধরনের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছে । এমনকি দগদগে ক্ষতচিহ্নগুলো দেখাতেও বার বার আপত্তি জানায় সে।
সাতক্ষীরা শহরের টাউনবাজার ব্রীজের বিপরীতে পলাশপোল মহল্লায় মো: আকরাম হোসেনের বাড়িতে ভাড়া থাকেন সাতক্ষীরা আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট,চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙা উপজেলার মো: নূরুল ইসলাম। অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, তিনি ও তার স্ত্রী নাতাশা প্রায়ই শিশুটির ওপর নির্যাতন করে থাকেন। প্রতিবেশীরা মেয়েটির চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেও তার সঙ্গে তারা কথা বলতে দিতেন না। দিনভর ঘরের দরজা বন্ধ থাকতো । মেয়েটির পিতা বা স্বজনদের সাথেও মোবাইলে কথা বলতে দেয়া হতো না শিশুটিকে। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকমত খাবারও দেয়া হতো না মেয়েটিকে। না খেয়ে তার শরীর যেনো ন্যুয়ে পড়েছে। মেয়েটি এতোটাই দুর্বল যে, তার কথা বলা বা ঠিক মতো চলারও শক্তি নেই।
মেয়েটি তার নাম বীথি ইসলাম এবং বাবার নাম গোলাম রসুল উল্লেখ করে জানায়, মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার বড় আমিয়ান গ্রামে তার বাড়ি। ক্লাস থ্রি তে পড়াকালীন তার বাবা তার মাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যা করে বলে অভিযোগ। তার প্রতিবেশি কাকা পরিচয়ের সাতক্ষীরা চীফ জুডিশিয়াল আদালতের কর্মচারী সোহরাব হোসেন সোহাগ তাকে সাতক্ষীরার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নূরুল ইসলামের বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসাবে নিয়োগ করান।