চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে পানিপথে মালয়েশিয়ায় পাচারের শিকার নয়, কিশোর বাড়ি ফিরলো॥
হাবিবুর রহমান,চুয়াডাঙ্গা : মিয়ানমারের বিজিপি কর্তৃক উদ্ধারকৃত জলপথে পাচারের শিকার বাংলাদেশিদের মধ্যে আলমডাঙ্গার ৯ জনসহ চুয়াডাঙ্গা জেলার ১১ জন বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফেরা আলমডাঙ্গার ৯ জনের মধ্যে শনিবার ৪ কিশোর আলমডাঙ্গা থানায় উপস্থিত হয়ে এলাকার আদম ব্যাবসায়ী দালাল চক্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে। এ সময় থানায় উপস্থিত প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৪ কিশোর গভীর সমুদ্রে নিদারুণ কষ্টে অবস্থানসহ দীর্ঘ প্রায় ৪ মাসের অবর্ণনীয় নির্যাতনের বর্ণনা দেয়।
জানা গেছে, আলমডাঙ্গা উপজেলার হাড়গাড়ি গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে মোশারেফ হোসেন (২৩), একই গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে মিনারুল ইসলাম (২৭), পাইকপাড়ার হাফিজুল ইসলামের ছেলে মিলন ওরফে মিলু (১৮) ও একই গ্রামের আত্তাব আলীর ছেলে তোতা মিয়া, ভাংবাড়িয়া গ্রামের আনারুলের ছেলে লিটন আলী (২৪), একই গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে লিটন (২৩), শ্যামপুর গ্রামের শামসুল হকের ছেলে জহুরুল, তিয়রবিলা গ্রামের ঠা-ু মালিথার ছেলে শহিদুল (২২) ও অজ্ঞাত ১ জনসহ বেশ কিছু সহজ-সরল কিশোরকে আদম ব্যাবসায়ী দালাল আব্দুর রাজ্জাক, হারদীর নাসির, পাইকপাড়া গ্রামের দালাল নজিবুল ওরফে মজিবুল ও এনায়েতপুর-বাড়াদী গ্রামের খোদাবক্সসহ কিছু দালাল ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে তাদেরকে বিপদে ঠেলে দেয়।
উদ্ধার হওয়া কিশোর তোতা জানিয়েছে, এলাকার চিকন একহারা চেহারার এক দালাল আমাদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখাতো। ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই যাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করে সে। দু লাখ করে টাকা দিতে হবে জনপ্রতি। এমনকি এ টাকাও নগদ দিতে হবে না। পরে কাজ করে পরিশোধ করতে হবে বলে জানায়। নিতান্তই বোকা ছাড়া কেউ এমন সুযোগ হাত ছাড়া করে না বলেও দালাল তাদেরকে আয়েত্বে আনার চেষ্টা করতো। এরই এক পর্যায়ে তারা রাজি হয় মালয়েশিয়া যেতে। প্রায় ৩ মাস ২৫ দিন আগে তাদেরকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সে দালালের নাম বলতে পারেনি। তবে জানিয়েছে, ওই পাতলা একহারা চেহারার দালাল তাদেরকে নিয়ে গিয়ে ঢাকার এক হোটেলে তুলে দেয়। ওই হোটেলে আগে থেকে অবস্থান করছিলো কুমারী গ্রামের রাজ্জাক নামের আরেক আদমব্যাবসায়ী দালাল। সেই তাদেরকে কক্সবাজারে নিয়ে গিয়ে পার্বত্য এলাকার এক হোটেলে তোলে। সেখানে দু দিন অবস্থানের পর তাদেরকে রাতে এক ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থানকারী এক বড়সড় জলযানে তুলে দেয়া হয়। তারা মোট ৮শ যাত্রী ছিলো। এদের মধ্যে ১শ মহিলা ও শিশু। প্রায় দেড় মাস অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে তারা গভীর সমুদ্রে। একপর্যায়ে তারা জানতে পারে মালয়েশিয়া ঢোকা সম্ভব নয়। এরপর সেই জাহাজের চালকরা ৯ জন ট্রলারে করে অন্যত্র চলে যায়। গভীর বিপদে পড়ে ৮শ যাত্রী। পরে কক্সবাজার এলাকার কয়েকজন যুবক হাল ধরে জাহাজের। তারা কিছুদিন সাগরে অবস্থানকালে জাহাজ চালনার ট্রেনিং নিয়েছিলো। সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশে ফেরত আসার। বাকি আনাড়ি চালকরা সূর্য যেদিকে ওঠে সেই দিকে জাহাজ চালাতে থাকে। এভাবে কিছুদিন জাহাজ চালিয়েও সমুদ্রের কোনো কুলকিনারা পায়নি। পরে এক মাছধরা মিয়ানমার ট্রলার দেখে এগিয়ে গিয়ে সাহায্য চাইলে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারা সকল প্রকার সহযোগিতা দিয়ে মিয়ানমারের সীমানায় নিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের সীমানারক্ষী বাহিনী বিজিপিকে তথ্য দেয়। ৩ মাসের অধিককাল সমুদ্রে ভাসার পর অবশেষে বিজিপি তাদেরকে উদ্ধার করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সংবাদ পাঠায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় (আইওএম)। তারা গিয়ে সব রকম সহায়তা দেয়। খাবার, গোসলের পানি, মশারি, পোশাক সবকিছু সরবরাহ করে। গভীর সমুদ্রে জলযানে থাকা অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে মিলন ওরফে মিলু জানায়, ২৪ ঘন্টায় মাত্র একবার এক প্লেট ভাত, শুকনো ঝালের গুঁড়ো আর এক ধরনের ওষুধ স্প্রে করে দিতো খাবার প্লেটে। দিতো মাত্র এক মগ পানি। রাত-দিনে দিতো দু মগ পানি। তার বেশি কেউ পানি কিংবা ভাত চাইলেই নির্মমভাবে পেটাতো। কাঠের লাঠি দিয়ে বেদম মারধর করতো। বাম পায়ের উরুতে এখনও সে মারের ব্যথা রয়েছে আমার। শরীরের অন্যান্য স্থানেও ব্যথা রয়েছে লাথি আর ঘুষির। খাবারের জন্যে আকুতি করায় এ নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো শুধু আমার না, সকলেরই। একজনের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার দেখে আর কেউ খাবার কিংবা পানি চাইতো না। মরে গেলেও কেউ সহজে মুখ খুলতো না। কেউ কথা বললেই লাঠি দিয়ে মারধর করা হতো। সেখানে অর্ধাহারে-অনাহারে ৩ মাসের অধিক দিন দুর্বিষহ কষ্টে কেটেছে। বার বার মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছে। সকলে মিলে কোরআন শরিফ খতম দিয়েছি।
বিজিপি উদ্ধারকৃত এ ৮শ জনের মধ্যে প্রথমে ১৫৫ জনকে ফেরত আনা হয়েছে। এদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ৯ জনকে প্রথমে নিরাপদে বাড়িতে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে এ ৯ জন শিশু-কিশোরকে কক্সবাজার আদালতে হাজির করা হলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুশান্ত প্রসাদ চাকমা এ আদেশ প্রদান করেন। এদেরকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি কক্সবাজার জেলা শাখার মাধ্যমে নিরাপদ হেফাজতে বাড়ি পৌঁছানোর জন্যও আদেশে বলা হয়েছে। অপর ১৪৬ জনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে শুক্রবার বাড়ি পাঠানো হবে। এদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলার ১১ জনকে গতকাল শনিবার বিকেলে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আলমডাঙ্গার ৯ জনের মধ্যে ৫ জন সরাসরি বাড়িতে চলে গেলেও ৪ জন উপস্থিত হন থানায়। এরা হলেন- হাড়গাড়ি গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে মোশারেফ হোসেন (২৩), একইগ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে মিনারুল ইসলাম (২৭), পাইকপাড়ার হাফিজুল ইসলামের ছেলে মিলন ওরফে মিলু (১৮) ও একই গ্রামের আত্তাব আলীর ছেলে তোতা। তারা গতকাল এলাকার কয়েকজন পানিপথে মানবপাচার দালালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।