খুলনা মহানগরসহ সারা দেশে জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ চরমে

বি, এম, রাকিব হাসান (খুলনা ব্যুরো):খুলনা মহানগরীর প্রধান প্রধান সড়ক জলাবদ্ধতায় আটকে আছে অনেক মানুষ যানবাহন, জনদুর্ভোগের স্বীকার নানান শ্রেণীর মানুষ। জলাবদ্ধতার সমস্য নিরসনে উপযুক্ত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হলেও তা এখনও বাস্তবের মুখ দেখেনি। গত খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার পর এবং তার পূর্বে নগর পিতা হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত তালুকদার আব্দুল খালেক খুলনার পাইপ লাইন ও খান খননের সঠিক উদ্যোগ নেয়। এরপরও খুলনা প্রধান প্রধান মহাসড়কগুলো একটু ভারী বর্ষণ হলে তলিয়ে জায় যাতায়ত অনুপযোগি হয়ে পড়ে। যা মানুষের দুর্ভোগের চরমে উঠতে শুরু করেছে। বিভাগীয় খুলনা সিটিকর্পোরেশন এলাকায় একটু ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় তাহলে প্রয়োজনীয় কর্মকান্ড যেমন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোর্ট, সরকারী-বেসরকারী অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নানান পেশার মানুষ এখন সমস্যায় পড়ছে। যা প্রধান প্রধান সড়ক আহসান আহম্মেদ রোড, হাজী মহসিন রোড, সাউথ সেন্টাল রোড, কেডি ঘোষ রোড, পিকচ্যার প্যালেচ মোড় ইত্যাদি প্রধান প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতায় নানান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিবার সিটি নির্বাচনের সময় প্রতিত্র“তি দেওয়া হলেও তার সঠিক এবং পরিপূর্ণ সমাধান পাচ্ছে না মহানগরীসহ সারা দেশের মানুষ। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে নগরীতে ভোগান্তি ও হয়রানি স্থায়ী রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর এ কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হলেও এর কোনো সমাধান না হওয়ায় ক্ষুব্ধ নগরবাসী। খুলনা মহানগর, রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটন নগরী সিলেটে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি। দখল-অব্যবস্থাপনায় রাজধানীতে জলাবদ্ধতা গত শনিবার সকাল সাড়ে আটটা। রাজধানীর কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে ভেজা শার্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। মতিঝিলে তার অফিস শুরু সকাল ১০টায়। আধ ঘন্টা অপেক্ষা করে বাস না পেয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে কিছুপথ হেঁটে, কিছুপথ রিকশা ও সিএনজিতে চড়ে সকাল পৌনে ১১টায় যখন অফিসে পৌঁছলেন তখন বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে তিনি। পথে যানজটের পাশাপাশি সড়কের নানা স্থানে হাঁটুপানি পার হতে হয়েছে তাকে।
আগের দিন শুক্রবার ঢাকায় ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পর জলাবদ্ধতা ও যানজটের কারণে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নগরবাসীর অনেককেই। আগের সপ্তাহের বৃহস্পতিবারের ৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত সৃষ্ট জলাবদ্ধতায়ও নাকাল হতে হয় ঘরের বাইরে আসা সব বয়স-পেশার নাগরিকদের। বর্ষা মৌসুমে এই ভোগান্তি ও হয়রানি যেন স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। প্রায় দেড় কোটি মানুষের বাস যে শহরে, সে শহরে প্রতিবছর জলাবদ্ধতার একই চিত্র উদ্বেগজনক বলেই মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা। পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা ঢাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি এবং এটি নিরসন না হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের নদী-খালগুলো বেদখল এবং আংশিক ভরাট হওয়া, নদীগুলোর ঢালে পর্যাপ্ত জায়গা না রাখা, পুকুর ও নর্দমাগুলো আবর্জনায় ভরাট কিংবা বিলুপ্তি, অপ্রতুল পানি নিষ্কাশন পাম্প, ড্রেনেজগুলোর বর্জ্য নিয়মিত অপসারণ না করা এবং বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুড়ি করা। এছাড়া জনসচেতনতার অভাব এবং ঢাকার দুইটি ফ্লাইওভারের পাশে পানি নিষ্কাশনে অব্যবস্থাপনা জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। যে সব এলাকায় জলাবদ্ধতা :সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দিনে ৫ থেকে ৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই খুলনা সিটিকর্পোরেশন আওয়াতাভুক্ত রয়েল মোড়, ফেড়িঘাট, হাজী মহসিন রোড, ডাকবাংলা এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশনভুক্ত গুলশান, বনানী, কুড়িল, কুড়াতলী, শাহজাদপুর, নতুনবাজার, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, খিলক্ষেত, উত্তরা, জোয়াসাহারা, অলিপাড়া, কুড়িল প্রগতি সরণী রোড, খাপাড়া, কাজী বাড়ি, মানববন্ধন রোড, জমজ রোড, মোল্লাবাড়ি রোড, কুড়িল কুড়াইত আলী রোড, ভাসানটেক, পল্লবীর কালশী, রূপনগর, মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, পীরেরবাগ, কল্যাণপুর, কাফরুল, মোহাম্মদপুর ও মগবাজার এলাকার সড়কগুলোতে পানি জমে যায়। অলি-গলিতেও পানি জমে থাকার কারণে ভোগান্তি সৃষ্টি হয়। বন্দি হয়ে পড়েন এসব এলাকার বাসিন্দারা। জলাবদ্ধতার কারণে দুর্ভোগ তৈরি হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনভুক্ত লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, চকবাজার, চাদনিঘাট, যাত্রাবাড়ী, মিরহাজীর বাগ, পূর্বধোলাইরপাড়, জুরাইন, পোস্তগোলা, ফরিদাবাদ, ধলপুর, মানিকনগর, গোপীবাগ, মুগদা, বাসাবো, মাদারটেক, কলাবাগান, ধানমন্ডিসহ সংলগ্ন এলাকাগুলোতেও। ঢাকা শহরে পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব পালন করে ঢাকা ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এ দায়িত্ব ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডও পালন করে। ঢাকা শহরে ওয়াসার প্রায় সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার ড্রেনেজ পাইপলাইন রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের রয়েছে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন। এছাড়াও দুই করপোরশনের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার ভূ-উপরিস্থ (সারফেস) ড্রেনেজ লাইন রয়েছে। বৃষ্টির পানি এসব ড্রেন লাইন হয়ে ওয়াসার ড্রেনেজ লাইন ও খালে গিয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসা ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ জানায়, ঘন্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা বর্তমান ড্রেনেজ-ব্যবস্থা ধারণ করতে পারে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) প্রায় দিনই এর ৫ থেকে ১০ গুণ বেশী বৃষ্টিপাত হয়। তাই ১০ মিলিমিটারের চেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হলে বিদ্যমান ড্রেনেজ লাইনে পানি সরতে বেশী সময় নিবে। কিন্তু ড্রেনেজ লাইন ও এগুলোর সংযোগ লাইনগুলোর বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য জমে থাকায় পানি নিষ্কাশনে বাধা তৈরি হয়। ফলে গত বৃহস্পতিবারের ৬৪ মি.মি বৃষ্টিপাতের কারণে ওই দিন ছাড়াও পরদিনও জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। আবার শনিবারের ৩৮ মি.মি, রবিবারের ৫ মি.মি ও সোমবারের ৮ মি.মি বৃষ্টিপাতের কারণে তিন দিনই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ওয়াসার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত চার বছরে প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন কিছু পাইপ লাইন চওড়া করা হলেও নতুন লাইন বাড়াতে পারেনি। নগরীর মিরপুর ও উত্তরা অঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটলেও মিরপুর এলাকার ৭০ ভাগ অংশেই ওয়াসার ড্রেনেজ লাইন নেই। উত্তরার বেশির ভাগ এলাকায়ও ওয়াসার ড্রেনেজ লাইন তৈরি করা হয়নি। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা কাঙ্খিতমানে উন্নত করার জন্য আরো অন্তত চার বছর সময় দরকার। এ সময়ের মধ্যে ড্রেনেজ লাইন সম্প্রসারণ ও প্রশস্তকরণের কাজ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকাসহ নানান শহুরে এলাকার জলাবদ্ধতার বড় কারণ এর চারপাশের নদীগুলো বেদখল হয়ে যাওয়া। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যতই উন্নত করা হোক না কেন, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করা না গেলে টেকসই ফল পাওয়া যাবে না। এ জন্য বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদী এবং টঙ্গী খালের দখল রোধ করা জরুরি। প্রসঙ্গত, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দখল-দূষণের জন্য দায়ী এক হাজারের বেশী শিল্প-কারখানা-প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছে আইডিইবি’র স্টাডি ও রিসার্চ সেল, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, আশির দশকেও ঢাকায় অন্তত ৪৭টি খালের অস্তিত্ব ছিল। তবে বর্তমানে এর অন্তত ২১টিই এখন হারিয়ে গেছে। বাকি ২৬টি খালও ক্রমে দখল হয়ে যাচ্ছে। দখলের ফলে অনেক খাল সরু হয়ে গেছে। শুধু নদী বা খাল দখল নয়, এগুলোকে ঘিরে উন্নয়ন কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনাও জলাবদ্ধতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী জুলফেকার আলী বলেন, ঢাকার নদীগুলোর দুই ঢালেই ১৫০ ফুট জায়গা খালি রাখার কথা থাকলেও সেসব অংশ দখল করে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। খালগুলোও ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত স্থান দরকার। খাল ভরাট ও নদী দখলের কারণেই জলাবদ্ধতা সমস্যা তীব্রতর হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি নদী, খাল, জলাশয়, জলাধারগুলোকেও সংরক্ষণ করতে হবে।
এমনিতেই বিভিন্ন শহরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপ্রতুল। এর ওপর ড্রেনেজ লাইনগুলোতে ময়লা জমে থেকে জলাবদ্ধতা সংকটকে তীব্র করে তুলছে।ওয়াসার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ড্রেনেজ লাইনগুলোতে ময়লা-বর্জ্য জমে থাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রায় সময়ই ভেঙ্গে পড়ে। ফলে জলজট ও জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সচল রাখতে জনবল স্বল্পতা প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন । সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাকেও তারা জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *