পানির মধ্যে বাস তবুও হাহাকার
বিএম রাকিব হাসান : ‘বয়সতো আর কম হলো না, এখন আর ঠিক ঠিক কানেও শুনতে পাইনে। আমরা তো মানুষ নই। এই চারিপাশে জল দেখছেন, জলের মধ্যেই বাস করছি; আর প্রতিদিন বিষ খাচ্ছি। বাপ-দাদায় জলের জন্য পুকুর কাইটে গেছে; তাও একশ’ বছর পার হচ্ছে। আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার লোক এই পুকুর থেকেই জল নিতো। কিন্তু তাও শ্যাষ! জল ভালো করতি গিয়া এখন তাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কি করবো; ওই দিয়াই চলতি হইচ্ছে।’ উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট জেলার মংলার দ্বিগরাজ গ্রামের ৮৩ বছরের সতীশ মহলদার অনেকটা এভাবেই বলছিলেন তার কষ্টের কথা। বলছিলেন সারা বছর পানির মধ্যে থেকেও পানির তীব্র হাহাকারের কথা। দ্বিগরাজ গ্রামের সতীশ মহলদারের পুকুরের মিষ্টি পানির সুনাম ছিলো অনেক দিনের। কেউ বলেন একশ’ বছর, আর কেউ আরো বেশী। হাজারো মানুষের চাহিদা মিটানো এ মিষ্টি পানির আঁধার শেষ হয়েছে মাত্র ৩/৪ বছর আগে! একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পুকুরটি সংস্কার কাজের উদ্যোগ ও পুনঃখননে এখন অনেকটাই মৃত ‘মহলদারের পুকুর’। শুধু মহলদারদের পুকুরই নয়, তীব্র খাবার পানি সংকটের শিকার খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলার বিভিন্ন উপজেলার অধিকাংশ সরকারি পুকুরের চিত্র এমনটা। আবার কোন কোনটি স্থানীয় প্রশাসক প্রভাবশালীদের ইজারা দেয়ায় পানির চাহিদা মিটাতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। ফলে তাদের একমাত্র ভরসা বৃষ্টির পানি। আর তা না হলে ৩০-৪০ টাকার বিনিময়ে একপট (৩০ লিটারের পাত্র) পানি। মংলাসহ আশপাশের উপকূলীয় এলাকা সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। দ্বিগরাজ গ্রামের গৃহিনী প্রতিভা মহলদার, ইরা মহলদার বলেন, জলের জন্য আমাদের কষ্টের শেষ নেই। এই বাড়ির (মহলদার) পুকুর ছিলো ১৫-২০ গ্রামের ভরসা। আইলার পর একটি এনজিও এই পুনঃ খনন কইরে সর্বনাশ করছে। তারা কিছু মাটিও কাটছে। কিন্তু জল আর আগের মতো মিষ্টি নাই। তারপরও দায় ঠেকে খাচ্ছি; ব্যবহার করছি।’ মিঠাখালী গ্রামের শ্রীমান মল্লিক বলেন, ‘এই গ্রামে বাছারের পুকুর। মাদুরপাটা, দোয়ারীজায়া, খোনকার বেড়, সাহেবের মোড়, খোরালীর মোড়, দ্বিগরাজসহ ৮/১০ গ্রামের মানুষের ভরসা ছিলো। ৪/৫ বছর আগে এক গ্র“প ওই পুকুর আবার কাটলো (পুনঃখনন)। আর সেই যে শেষ হইলো আর ঠিক হয় নাই।’ মৎস্য ব্যবসায়ী খোনকারবেড় গ্রামের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘চিংড়ি চাষের জন্য মংলাসহ উপকূলীয় এলাকার বিঘার পর বিঘা জমি সারা বছরই নোনা পানি ধরা রাখা হয়, তাই চারপাশে নোনা পানি রেখে মিষ্টি পানির পুকুর বাঁচানো যাচ্ছে না। আবার সরকার পুকুর সংস্কারের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও তা কাজে আসে না।’ খুলনার দাকোপ উপজেলার পানি অধিকার কমিটির নেতা গৌরাঙ্গ প্রসাদ রায় বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন নোনা পানি তুলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, মিষ্টি পানির আঁধার খাল-পুকুর ও জলাশয় ইজারা না দেয়ার জন্য আন্দোলন করছি। কিন্তু বাস্তব কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। এতে কতিপয় লোক লাভবান হলেও গোটা উপকূলের বাসিন্দাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে- মেয়েরাও পানির জন্য হাহাকার করছে।’ এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেল্থ-এর এ্যাডভোকেসী ও তথ্য হেড যোসেফ হালদার বলেন, ‘উপকূলীয় পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের চমৎকার একটি নীতিমালা রয়েছে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ইউনিয়নে কমপক্ষে একটি মিষ্টি পানির পুকুর থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। বরং বেসরকারি উদ্যোগের পুকুরগুলো নানা প্রকল্পের মাধ্যমে নষ্ট করা হচ্ছে।’ উদাহরণ দিয়ে যোসেফ হালদার বলেন, মংলার বুরবুরিয়ার পুকুর, বাছারের পুকুর, মহলদারের পুকুর, উত্তর বাঁশতলা পুকুরসহ পানি উৎস আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। এদিকে গত ২৫ মে খুলনা জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে এনজিও ফোরাম ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ‘পানি -অধিকার: দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বাস্তবতায় আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সংলাপে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মিষ্টি পানির আঁধার হিসেবে পরিচিত সরকারি পুকুর জলাশয় ইজারা না দেয়া, যেসব জলাধার ইজারা দেয়া হয়েছে; জনস্বার্থে তা বাতিলের প্রতিশ্রুতি সরকারি কর্মকর্তারা।