দুই প্রধানমন্ত্রীর একই সুর সম্পর্ক আরোপ নয় উন্মোচন

4543ff7ac108fbcc96d5dcd4ff5f1ca8-Sequence-01ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পরের প্রতিবেশীই কেবল নয়; ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা দুটি জাতি। উন্নয়নের মহাসড়কে উভয় দেশই পরস্পরের সফল সঙ্গী। ভারতের জন্য যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমি দেখি, একই প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও। প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে এসে এ অভিমতই ব্যক্ত করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রায় একই সুরে কথা বললেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তার ভাষায়, ভারত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। সেই সঙ্গে পরস্পরের উন্নয়ন সহযোগীও। পারস্পরিক উদ্বেগ ও অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোয় আমরা অবগত। গতকাল সকাল ১০টা ৮ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অভ্যর্থনা জানান। প্রধানমন্ত্রীর এ অভ্যর্থনার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই টুইট করেন নরেন্দ্র মোদি। লেখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য ধন্যবাদ। আমি একটি সুন্দর সফর আশা করছি, যা ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার সফরের শুরুতেই সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সভারের একটি তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন শেষে যান বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি ও কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা সরাসরি বাস সার্ভিস উদ্বোধন করেন। এর পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিতি হন নরেন্দ্র মোদি। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ ব্রিফিংয়ে অংশ নেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। দ্বিপক্ষীয় বৈঠককে ফলপ্রসূ ও গঠনমূলক বলে আখ্যায়িত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যৌথ সংবাদ বিবৃতিতে বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয় নিয়েই আমাদের খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং আমি উভয়ই কানেক্টিভিটির বিষয়ে সম্মত হয়েছি। কানেক্টিভিটি শুধু বাংলাদেশ-ভারতের নয়। এ অঞ্চলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় নৌ-চলাচল চুক্তি, বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন, অভ্যন্তরীণ নৌ-প্রটোকল স্বাক্ষর এবং নতুন বাস সার্ভিসগুলো এ অঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ প্রতিষ্ঠার প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত। এর মধ্য দিয়েই এ অঞ্চলের জনগণের জন্য একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়তে পারব। এ চুক্তিগুলোর ফলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ব্যবসা প্রসারে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সার্বিক সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। দুই দেশের বাণিজ্যে সমতা আনতে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য মংলা ও ভেড়ামারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির বিষয়ে আমরা সম্মত হয়েছি। এতে বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সীমান্ত শান্তিপূর্ণ রাখা ও পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আমরা আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছি। আলোচনা হয়েছে ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদী ব্যবস্থাপনায় একযোগে কাজ করার বিষয়েও। দুই দেশের জনগণের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, গুয়াহাটিতে বাংলাদেশ মিশন এবং খুলনা ও সিলেটে ভারতীয় মিশন খোলার বিষয়ে সম্মত হয়েছি; যা পারস্পরিক বিশ্বাস ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো বিস্তৃত করার অঙ্গীকারেরই প্রতিফলন। বাংলাদেশে আতিথেয়তার প্রশংসা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, সকালে আমি এ দিগন্তের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাই। তার দূরদৃষ্টি, নেতৃত্ব, মানবিক দিক ও ত্যাগ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সোনার বাংলার সে স্বপ্নই আজ শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের প্রতিভাবান জনগণের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। এ সফর তার জন্য বিশেষ মুহূর্ত বলে উল্লেখ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এখানকার অগণিত মানুষের শুভকামনা আমার যাত্রাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। আমরা শুধু প্রতিবেশীই নই। আমরা দুটি দেশ ইতিহাসের সুতোয় বাঁধা; যেখানে রয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও আত্মীয়তা। সেই সঙ্গে ক্রিকেটের জন্য ভালোবাসা। আমাদের সংগ্রাম ও ত্যাগের আবেগের বন্ধন রয়েছে। আমরা উন্নয়নের পথের সহযাত্রী। ফলে যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমি ভারতের জন্য দেখি, একই ভবিষ্যৎ আমি বাংলাদেশের জন্যও আশা করি। আমরা দুটি বাস সার্ভিস চালু করেছি; যা আমাদের জনগণের যোগাযোগ আরো সহজ করবে। দুই দেশকে আরো কাছে নিয়ে আসবে। তিনি বলেন, আমাদের জনগণের মধ্যে আরো যোগাযোগ বাড়বে; যা আমাদের আরো সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বের অর্থনীতির নতুন দরজা খুলে দেবে। শক্তিশালী পূর্বের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগ স্থাপন করবে। সার্ক বাংলাদেশের একটি উপহার উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, আমরা (বাংলাদেশ ও ভারত) জাতিসংঘে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে থাকি। আমাদের অঞ্চল ও সমুদ্রকে আরো নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করতে পারি। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক দুই দেশের জন্য তো বটেই, এ অঞ্চলের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যকার ইস্যুগুলোর বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে ঝুলে থাকা অমীমাংসিত ইস্যু আমরা সমাধান করেছি। আমাদের দুই দেশের সমাধানকৃত সীমান্ত রয়েছে; যা আমাদের সীমান্তকে আরো নিরাপদ করবে। সেই সঙ্গে সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা আরো সহজ করবে। আমাদের সমুদ্রসীমার সমস্যা গত বছর সমাধান করেছি। এটি আমাদের সম্পর্কের পূর্ণতা এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার অঙ্গীকারেরই নিদর্শন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সম্পর্কের সম্ভাবনার মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আমি তা অনুধাবন করেছি। সম্ভাবনার সব বিষয় নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করব। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সামনে রেখে পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাধান করব। চুক্তিগুলো আমাদের ভিশন ও অঙ্গীকারের প্রতিফলন। বিভিন্ন চুক্তির বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। আর অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ভারতীয় বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। নতুন সীমান্ত হাট ঐতিহ্যগত বাণিজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে ব্লু ইকোনমি নিয়ে চুক্তি ও সহযোগিতা অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এখন আমাদের মহাকাশে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের পরও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বিশাল বাণিজ্য ব্যবধানের বিষয়ে আমি অবগত। এ ব্যবধান কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছি। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ বিষয়টিতে সহায়তা করবে। বিদ্যুতের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, বর্তমানে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রফতানি হচ্ছে। আগামী দুই বছরে এ পরিমাণ ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সামনে বিদ্যুৎ খাতে আরো কিছু করার রয়েছে। কানেক্টিভিটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো গভীর করবে উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, সড়ক, রেল ও নদীপথে কানেক্টিভিটি; বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও জ্বালানি তেলের পাইপলাইন এবং ডিজিটাল সংযোগ সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়বে। আমরা আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি আরো গভীর করব। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতা আরো বাড়াব। অভিন্ন নদী বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, নদী আমাদের সম্পর্কের ভিত হতে পারে। এটি অনৈক্যের কারণ হতে পারে না। সবকিছুর ওপর নদীর পানি বণ্টন একটি মানবিক ইস্যু। এটি সীমান্তের দুই পাশেই মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। আমি আত্মবিশ্বাসী, রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় ভারত তিস্তার পানি বণ্টন ও ফেনী নদীর ইস্যুতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, শত বাধার মুখে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত একে শ্রদ্ধা করে। আপনার ২০২১ ও ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা সফল হবে। বাংলাদেশে সফলতা শুধু বাংলাদেশের স্বার্থেই নয়; এ অঞ্চল, বিশ্ব ও বাংলাদেশ-ভারত অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্কের জন্যও জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *