সাগরপথে মালয়েশিয়া: রূপগঞ্জের অর্ধশতাধিক যুবক নিখোঁজ

malaysia-atokনারায়ণগঞ্জ: দালালরা গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাতভরা টাকা উপার্জনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল বেকার, অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত যুবকদের। তাদের চাটুকরি কথা বিশ্বাস করে অবৈধভাবে স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়েছিল রূপগঞ্জের অর্ধশতাধিক যুবক। যারা এখন নিখোঁজ।

শুধু তাই নয়, মালয়েশিয়ায় নেয়ার কথা বলে যাদের বাড়ি থেকে নেয়া হয়েছিল তাদের মালয়েশিয়া পৌঁছে দেয়া হয় নি বরং আটক করে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত প্রত্যেক স্বজনদের কাছ থেকেই দালালরা টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ যুবকরা এখনো বাড়ি ফিরতে পারেনি। এতে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোতে বিরাজ করছে চাপাকান্না।

সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দিদের গণকবরের খবর ছড়িয়ে পড়ায় নিখোঁজ স্বজনদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম, ঘরে ঘরে বোবাকান্না। মানবপাচারকারীর একটি সিন্ডিকেট এলাকার অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া নেয়ার জন্য এখনো দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কম টাকায় সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অর্ধশতাধিক যুবক। মালয়েশিয়ায় চাকরি দেয়ার নাম করে প্রথমে বিনামূল্য পরে কাজ করে টাকা পরিশোধের লোভ দেখিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য করে দালালরা। পরে যুবকদের বিশেষ নৌকায় উঠিয়ে টাকার জন্য নির্মমভাবে হত্যা কিংবা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দি করে রেখে মুক্তিপণ আদায় করে তারা। অনেক অভিভাবক ভিটেমাটি বিক্রি ও ধারদেনা করে প্রিয়জনকে ফিরিয়ে আনতে দালালদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন। টাকা-পয়সা খরচ করেও কেহ তাদের সন্তানের হদিস পাচ্ছেন না।

নিখোঁজদের স্বজনেরা জানান, রূপগঞ্জ উপজেলার কলাতলী এলাকার হাফিজউদ্দিনের ছেলে হারুন মিয়া, একই এলাকার জয়নাল, চান্দু মিয়ার ছেলে আরমান, কাঞ্চন চৌধুরীপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আলী, ভোলাবো এলাকার রমজান মিয়া, মতলিব মুন্সির ছেলে খোরশেদ, কেরাব এলাকার মোহাম্মদ আলী, নরসিংদীর আলিমউদ্দিন, আড়াইহাজারের শাহ আলী, কলাগাছিয়া গ্রামের সামসুল হকের ছেলে ইয়াকুব মিয়া, কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার মোহাম্মদপুর দক্ষিণ আলীবাজার এলাকার সেকান্দার আলীর ছেলে খোরশেদ আলম মানব পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য।

এ দালাল চক্র গত ৬ মাসে রূপগঞ্জ উপজেলার সাওঘাট গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে হানিফ মিয়া, কাঞ্চন পৌরসভার দক্ষিণ বাড়ৈ পূর্বটেকপাড়া গ্রামের নুরু মিয়ার ছেলে হালিম মিয়া, দেবই কাজীরবাগ এলাকার অতু মিয়ার ছেলে তারিকুল ইসলাম, ওয়াদুদ মিয়ার ছেলে মাহফুজুর রহমান, কুশাবো গ্রামের ইয়াকুবের ছেলে রাসেল, সরাবদী গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে আবুল কালাম, বৈলারকান্দি গ্রামের জয়নাল মিয়ার ছেলে ইব্রাহিম মিয়া, কাশেম আলীর ছেলে মাসুম মিয়া, উজিরত আলীর ছেলে তাজু মিয়া, সোনা মিয়ার ছেলে মজিবুর রহমান, জামাতা আকতার হোসেন, হাসনহাটার আবুল হোসেনের ছেলে মতিউর রহমান, ফজলু মিয়ার ছেলে শামীম মিয়া, ইমান আলীর ছেলে আরিফ মিয়া, বাচ্চু মিয়ার ছেলে মোশারফ হোসেন, কলাতলী এলাকার মামুন মিয়া, আবু বক্কর, শফিকুল ইসলামসহ অর্ধশতাধিক যুবককে মালয়েশিয়া পাঠায়। সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে রূপগঞ্জের কলাতলী এলাকার জয়নালের ছেলে বাদল মিয়া থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে যাত্রীদের নিয়ে যায় মুক্তিপণ আদায়কারীদের আস্তানায়।

সম্প্রতি নরকযাত্রা থেকে ফিরে এসে কলাতলী এলাকার শামীম মিয়া, বুরুটিয়া এলাকার হারুন মিয়া সাগরপথে নির্যাতনের কথা জানান।

তারা জানান, দালালরা শুরুতেই প্রলোভন দেখায়। দাবি করা হয়, ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া নিয়ে চাকরি দেয়া হবে। দালালের এ আকর্ষণীয় শর্তে অনেকেই সাড়া দেন। এরপর শুরু হয় সাগরপথে যাত্রা।

এদের অনেকেরই পরে ঠিকানা হয় থাইল্যান্ডে মুক্তিপণ আদায়কারীদের আস্তানা বা বন্দি শিবিরে। কারও আবার মৃত্যু হয় সাগরপথে সাম্পান নৌকায় বা ট্রলারে।

উপজেলার কলাতলী এলাকার সেরাজউদ্দিনের ছেলে মামুন মিয়া জানান, কাঞ্চন পৌরসভার কলাতলী এলাকার দালাল জয়নাল মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য ১ লাখ টাকা নেয়।

সাগরপথে পাঠানোর কথা বললে সে রাজি হয়নি। টাকা ফেরত না দিয়েই আদম ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন কাঞ্চন এলাকা থেকে ৬-৭জন যুবককে নিয়ে টেকনাফের সাফুরদ্দি চলে যায়। সেখান থেকে বিশেষ নৌকা যোগে তাদের মালয়েশিয়া পাঠায়। সাগরপথে পাঠানো ওই যুবকরা এখনো নিখোঁজ রয়েছে। তবে স্বজনদের কাছে দালালেরা মুক্তিপণ হিসেবে এখন লাখ লাখ টাকা দাবি করছেন। জয়নাল দালাল এখনো এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘দালালদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।’ কেউ মুক্তিপণ দাবি করলে পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানান তিনি।

রূপগঞ্জ উপজেলা কারিতাসের সেইফ মাইগ্রেশনের কর্মকর্তা অনামিকা মন্ডল জানান, অবৈধ পথে মালয়েশিয়া গিয়ে অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন। নিখোঁজদের উদ্ধারে সব ধরণের চেষ্টা চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *