তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জালভোট ও অনিয়মের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ সাংবাদিক। ভেঙে ফেলা হয়েছে ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমের দুটি ক্যামেরা। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে থাকা মানিব্যাগ, ডায়েরি এবং পরিচয়পত্রও নিয়ে যায় হামলাকারীরা। এর আগে সকালে ভোট গ্রহণের শুরুতেই কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয় পুলিশ। নির্বাচন কমিশনের কোন নির্দেশনা না থাকলেও অনেক কেন্দ্রে সাংবাদিকদের চারশ’ গজের ভেতর ভিড়তে দেয়া হয়নি। কোন কোন কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশের সুযোগ দিয়ে পরে বের করে দেয়া হয় দ্রুত সময়ের মধ্যে। বেলা দুটার পর অনেক কেন্দ্রেই সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি ছিল পুলিশের। যদিও এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট কারও কোন সহযোগিতা মিলেনি। উল্টো হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয় সাংবাদিকদের। নির্বাচন কমিশনের কোন নির্দেশনা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ কর্তারা সাংবাদিকদের কেন্দ্র ও বুথে প্রবেশ করতে বাধা দেন। এমন অবস্থা ছিল দিনভর। সকালে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ওবায়েদ অংশুমান। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আশরাফুজ্জামান ফরিদের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়। ফরিদ তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আজাদ মোহাম্মদ সাদেকুল ইসলামের ওপর আহমেদাবাদ হাইস্কুলের সামনে হামলা চালায়। ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয় এবং নিজেরাই ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে জমা করতে থাকে। এসব অনিয়মের ছবি সংগ্রহ করার সময় ফরিদ তার লোকজন নিয়ে সাংবাদিক ওবায়েদের ওপর হামলা করে। বেধড়ক মারধর শুরু করে। এতে তার জামা ছিঁড়ে যায়। পুরো শরীরে মারাত্মক আঘাত পান তিনি। সকাল ৮টায় ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখার সময় মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের সঙ্গে থাকা যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন আখলাক সাফার ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তিনি বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের এজেন্টদের বের করে দেয়ার ছবি ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন। এ সময় যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরা ভাঙচুর করে আখলাক সাফাকেও মারধর করা হয়। সকাল ৯টা ২০ মিনিটে সেগুনবাগিচা স্কুলের সামনে যুগান্তর পত্রিকার ফটো সাংবাদিক শামীম নূর ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্যাতিত হন। তার ক্যামেরায় ধারণ করা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনিয়মের চিত্র মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্বাচনের তথ্য সংগ্রহ করছিলেন ডেইলি স্টার পত্রিকার রিপোর্টার পরিমল পাল ও মাহবুব খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেক্স ভবনে তারা কিছু বহিরাগতকে ভোট দিতে দেখেন। এদের একজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সে তাদের বাইরে আসতে বলে। পরে সাংবাদিকরা তাকে এড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য পরিমল এবং মাহবুব ঢাকা মেডিক্যালের সামনে খাবারের দোকানে আসলে ছাত্রলীগের ১২-১৫ জন নেতাকর্মী তাদের ওপর হামলা করে। হামলাকারীরা মাহবুবকে থাপ্পড় দিয়ে চলে যেতে বলে এবং পরিমলকে বেধড়ক কিল, ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। একপর্যায় পরিমলের মোবাইল ফোন, পরিচয়পত্র এবং মানিব্যাগ রেখে দিয়ে তাকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলে একই পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আনিসুর রহমান ভোটার বিহীন কেন্দ্রের ছবি তুলতে চাইলে কয়েকজন যুবক তাকে ঘিরে ধরে। কেন ছবি তুলছেন- জানতে চায়। যুবকরা তাকে ধাক্কা দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। সেখান থেকে বের হয়ে আনিস যান সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। সেখানে তিনি প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং বুথের ভেতরে বেশ কয়েকজন যুবককে দেখেন। বুথের ছবি তুলতে গেলে কিছু যুবক তাকে কেন্দ্র ত্যাগ করার জন্য বলে। কাফরুলে ডেইলী স্টারের আরেক ফটো সাংবাদিক পলাশ একজন অস্ত্রধারীর ছবি তুললে তাকে ঘিরে ধরে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ছবিগুলো মুছে ফেলে। একই পত্রিকার আরেক সাংবাদিক রাফি কমলাপুর শেরে বাংলা হাইস্কুলে সকাল ১১টায় অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ করতে চাইলে আওয়ামী লীগের এক কর্মী তাকে বাধা দেয় এবং কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। দুপুর দেড়টায় রাজধানীর শাহাজাহানপুরের মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারার খবর সংগ্রহ করতে গেলে হামলার শিকার হন প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার সুজন মহাজয়। এসময় হামলাকারীরা তার দুইটি মোবাইল ফোন, প্রথম আলোর পরিচয়পত্র এবং নির্বাচন কমিশন থেকে সরবরাহ করা পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়। দুপুর ১২টায় একই পত্রিকার আরেক সিনিয়র রিপোর্টার মোশতাক আহমেদ সরকার সমর্থক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের হামলার শিকার হন। ঢাকা দক্ষিণের নারিন্দার মৈশন্ডি স্কুল কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই সাংবাদিকের মোবাইলে তোলা ছবি মুছে ফেলা হয়। সঙ্গে থাকা ডায়েরি ও মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে যায় হামলাকারীরা। পরে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে হামলাকারীরা তাকে মারধরের হুমকি দেয়। সকালে মিরপুরের একটি ভোটকেন্দ্রে একটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন একজন পুলিশ সদস্য। এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দেয়। ঘটনাস্থল থেকে ফিরে একজন নির্বাচন কমিশনারকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন ওই সাংবাদিক। তাকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন কমিশনার ঘটনাস্থলে গেলে তার সামনে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে ওই পুলিশ সদস্য। পরে সিইসিকে বিষয়টি অবগত করলে তিনি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেন। তবে ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানা যায়নি। দুপুরে উত্তরা গার্লস হাইস্কুলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হকের প্রতীক গলায় ঝুলিয়ে জাল ভোট দেয়ার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হন সমকাল পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি অমিতোষ পাল। এ ঘটনায় এক সাংবাদিক ক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। দুপুর ২টায় ঢাকা দক্ষিণে বাসাবো উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষে অনলাইন পোর্টাল রাইজিং বিডির সাংবাদিক ইয়াসিন রাব্বী গুলিবিদ্ধ হন। এদিকে চট্টগ্রামেও তিন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। গুরুত্বর আহত অবস্থায় তারা চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সকাল ১০টায় হালি শহরের কেজি অ্যান্ড হাইস্কুল কেন্দ্রের বাইরের মারামারির ঘটনা ধারণ করার সময় একপক্ষের হামলার শিকার হন একাত্তর টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার আজাদ তালুকদার ও ক্যামেরাম্যান জহিরুল ইসলাম। হামলাকারীরা লাঠি দিয়ে জহিরুলের মাথায় আঘাত করে এবং ক্যামেরা ভাঙচুর করে। এতে জহিরুলের মাথা ফেটে যায়। বেলা ১১টায় আগ্রাবাদ ব্যাপারিপাড়ায় তালিবিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জালভোটের ছবি তুলতে গিয়ে হামলার শিকার হন আরটিভির ক্যামেরাম্যান পারভেজুর রহমান। আহত সাংবাদিকরা জানান, হামলাকারীদের সবার গলায় হাতী মার্কার প্রতীক সংবলিত কার্ড ঝুলছিল।