খুলনার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দশ বছরেও ভাঙা হয়নি
বিএম রাকিব হাসান, খুলনা থেকে : সাভারের ঘটনার পর কেডিএ নগরীর ৯টি ভবন ঝুঁকিপূর্ন চিহ্নিত করে তা অতি দ্রুত ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য বাড়ির মালিকদের নোটিশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল শুন্য। পাশাপাশি ১০ বছরেও খুলনার দুই শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে না ফেলায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা জোরালো হচ্ছে। এর মধ্যে মহানগরীর বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র বড় বাজারে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। নগরীর মুজগুন্নী ও নিরালা আবাসিক এলাকার খাল, জলাধার, চাষাবাদের নরম মাটিতে দ্রুত অধিক মুনাফা অর্জনের লোভে এক শ্রেনীর ভবন মালিক আবাসিক ভবন গড়ে তুলেছে কেডিএ’র প্লান/ নকশার বাইরে। যার ৩ তলার অনুমোদন সে ৫ তলা গড়ে তুলেছে। মাটির শক্তি নেই সেই ভবনটিকে ধরে রাখার। কেডিএ’র সয়েল টেষ্ট করে যেগুলি ৩ তলার বেশি অনুমোদন দেয়নি সেগুলির মালিক কেডিএ’র চোখ ফাঁকি দিয়ে গড়ে তুলেছে ৫ তলা বা তার বেশি। ফলে ভবনগুলো বিভিন্ন দিকে হেলে রয়েছে। যেকোন মুহুর্তে ঘটতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়।
সূত্রমতে, ২০০৪ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশন নগরীর এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করলেও তার একটিও ১০ বছরে ভাঙা সম্ভব হয়নি। ভবনগুলো ভেঙে ফেলার জন্য প্রত্যেক বছর তোড়জোড় করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বসবাসের অযোগ্য শত বছরের পুরানো ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনে বাস করছেন কয়েক হাজার মানুষ। এসব ভবন যে কোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। ঘটতে পারে সাভারের রানা প্লাজার মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা।
প্রতি বছরই এসব বাড়ি নিজ খরচে ভেঙে ফেলার নোটিশ দেয় সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু সে নোটিশে আজ পর্যন্ত কারও টনক নড়েনি। এরই মধ্যে এসব ঝুকিঁপূর্ণ ভবন ধসে কয়েকবার হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে বাসিন্দাদের এরপরও সরানো যায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনে কয়েক শতাধিক পরিবার বসবাস করছেন। রয়েছে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও।
সূত্রমতে, সর্বশেষ ১/১১-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশ মোতাবেক ২০০৮ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) মাধ্যমে ৪৪টি ভবনকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আরও ১০৭টি বাড়িকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করে। এই ১০৭টি ভবনের মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশনের চিহ্নিত ৪৪টি ভবনের সঙ্গে আরও ৫০টি ভবন যোগ হয়ে কেসিসি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪-এ। পক্ষান্তরে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাভুক্ত এলাকা নওয়াপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় নওয়াপাড়া পৌরসভা ও দামোদর ইউনিয়ন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৫৭টি। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২০১টিতে।
সূত্র মতে, ২০০৮ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে খুলনা জেলা প্রশাসন, খুলনা সিটি করপোরেশন, দামোদর ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ এবং নওয়াপাড়া পৌরসভা বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। সে মোতাবেক এসব ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ ও বসবাসের যোগ্য নয় লিখিত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর এসব ভবন ভেঙে ফেলার জন্য দেওয়া হয় কয়েক দফা নোটিশও। তবে এতে সাড়া দেননি সংশ্লিষ্ট ভবনের মালিক বা ব্যবহারকারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নগরীর বড়বাজার এলাকায় জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ২৬টি ভবনের অধিকাংশ দোতলা বা তিনতলা। এসব ভবনের ওপরের অংশে লোকজন বসবাস করছেন এবং নিচতলায় দোকানপাট ও কাঁচামালের আড়ত। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনে বসবাসকারী মানুষ ও বাজারে আসা লোকজনের জীবন হুমকির মুখে রয়েছে। এ বাজারে ২০০৮ সালে একটি ভবন ধসে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হন। নগরীর জেলা কারাগারের পুরোনো ভবন, টুটপাড়া আনসার ক্যাম্পের ভেতরে ভূতের বাড়ি, খুলনা জেনারেল হাসপাতালের সামনে একটি তিনতলা ভবন ঝুঁকিপূর্ণ।
এছাড়া খুলনা প্রেসক্লাবের অদূরে স্যার ইকবাল রোডে, বসুপাড়া, হাজি মহসিন রোড, গগনবাবু রোড, মুন্সিপাড়া, রায়পাড়া, দোলখোলা, বানিয়াখামার, টুটপাড়া, মুজগুন্নী, খালিশপুর, দৌলতপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। জরাজীর্ণ এসব ভবনের দেয়ালে পাকুড় ও বটগাছসহ বিভিন্ন ধরনের আগাছা জন্মেছে। অনেক আগেই এসব ভবনের পলেন্তারা খসে পড়ে দেয়ালগুলোয় ফাটল দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির সময় ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে।
সূত্রমতে, সর্বশেষ নগরীর মুজগুন্নি আবাসিক এলাকার ১৫ নং প্লটের বাসিন্দা মুর্শিদা বেগমের ৫ম তলা বাড়ি পশ্চিম দিকে হেলে গেছে। ৫ম তলার একটি অংশ প্রকৌশলী ইদ্রিস আলীর ছাদে গিয়ে পড়েছে। ৭ নং রোডের ১৮ নং প্লটের জনৈক শামিমার ৪তলা বাড়িতে ইটিলা প্রবাসী খালিদ হোসেনের ৫তলা বাড়ির অংশ হেলে পড়লে শামিমার বাড়িটির কিছু অংশ মাটিতে দেবে যায়। বিষয়টি এলাকাবাসীকে কেডিএকে জানালেও এখনও কেডিএ’র ঘুম ভাঙ্গেনি।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের এস্টেট অফিসার বলেন, বার বার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মালিকদের নোটিশ দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়াতে সিটি করপোরেশন আন্তরিক। এ কারণেই এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ভবনের মালিকানা নিয়েই মামলা রয়েছে। এজন্য উদ্যোগ নিয়েও ঝুকিঁপূর্ণ ভবন ভাঙা সম্ভব হয়নি। একদিকে ভবন ধসে পড়ার আশংকা, অন্যদিকে মাথা গোজার শেষ ঠাঁই।
স্থানীয়রা বলছেন, এই ঝুঁকি নিয়ে যারা এসব ভবনে বাস করছেন জীবন বাঁচাতে তাদের শিগগির বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। তা না হলে ঢাকার সাভারের রানা প্লাজার মতো ভবন ধসে ঘটতে পারে বড় ধরণের প্রাণহানির ঘটনা।
খুলনা জর্জ কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, “পরিত্যক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙতে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। মৃত্যুফাঁদ এসব ভবনে আর কোন সাভার ট্রাজেডি যেন না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে, মহানগরীতে ইমারত নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ইমারত বিধিমালায় বলা হয়েছে সর্বোচ্চ ৭ তলা ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদফতর, গ্যাস, ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি হাইরাইজ ভবনে ফায়ার ডিটেক্টর, স্মোক ডিটেক্টর, উচ্চগতির পানি ¯েপ্র সিস্টেম ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন সিস্টেম থাকাও বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-১৯৯৬-এর ১২ নম্বর ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী ৮ তলা উচ্চতার বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারতের সামনে কমপক্ষে ২৫ ফুট এবং ছয় তলা উচ্চতার বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৫ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকা বাধ্যতামূলক। এ বিধিমালার ৮ নম্বর বিধির ৫ উপবিধি অনুযায়ী উল্লে¬খিত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী সড়কের কেন্দ্র থেকে কমপক্ষে চার দশমিক পাঁচ মিটার অথবা সড়ক সংলগ্ন ইটের সীমানা থেকে এক দশমিক পাঁচ মিটার দূরে ইমারত নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া সর্বোচ্চ ৭ তলা ভবন নির্মাণের সময় পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু আইনে পরিবেশ ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক হলেও নগরীর বেশির ভাগ ভবন নির্মাণে এসবের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। তবে খুলনা মহানগরীতে ওই মুহুর্তে কতগুলো ইমারত নির্মাণের কাজ চলছে তা জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।