অবশেষে ফাঁসিতে ঝুললেন কামারুজ্জামান
ঢাকা : একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ৩১ মিনিটের দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। তবে কারা সূত্রে জানা যায় রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
রাত ১০টা ৩১ মিনিটে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় বলে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ নিশ্চিত করেছেন। একই কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া।
এদিকে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার পর দ্বিতীয় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসিতে ঝুললেন কামারুজ্জামান। নানা নাটকীয়তার পর রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না চাওয়ায় তার এ রায় কার্যকর করা হয়েছে। কামারুজ্জমানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ।
সব প্রকার আইনি জটিলতা শেষে কারাবিধি অনুযায়ী শনিবার রাত ১০টা ৩১ মিনিটে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শেরপুরের কুখ্যাত বদর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। জল্লাদ রাজুর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের জল্লাদবাহিনী ফাঁসি প্রদান করে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন আইজি প্রিজন ইফতেখার উদ্দিন, অ্যাডিশনাল আইজি প্রিজন কবির হোসেন, ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী, ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মালেক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ফখরুল কবির, কারা চিকিৎসক আহসান হাবিব।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শেরপুরের সোহাগপুরে ১২০ জন হত্যার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলে দণ্ডিত হলেন তিনি।
এর আগে শনিবার দুপুর ২টা ৪৮ মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের নির্বাহী আদেশটি কারাগারে পৌঁছায়। তার আগে নির্বাহী আদেশের ফাইলে স্বাক্ষর করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
কামারুজ্জামানের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে কারাগার এলাকা। কারাফটকের সামনে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। কারারক্ষী, র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে চারটি ব্যারিকেড দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় কারা ফটকের সামনে ও আশেপাশের রাস্তায় যান চলাচল।
ফাঁসি কার্যকরের আগে সন্ধ্যায় লালবাগ জোনের ডিসি মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশনা আছে। সে অনুযায়ী কারাগার এলাকায় র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।’
তিনি জানিয়েছিলেন, কারা এলাকায় ৫৬ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ১৪ সদস্য) পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
স্বজনদের সঙ্গে শেষ দেখা
শনিবার রাতে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার আগে বিকেলে শেষবারের মতো কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন তার পরিবারের সদস্যরা। বিকেল ৪টার দিকে তারা দুটি মাইক্রোবাসে করে কারা ফটক দিয়ে ভেতরে যান। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিলউদ্দিন, কামারুজ্জামানের স্ত্রী নূরুন্নাহার, মেজো ছেলে হাসান ইমাম, মেয়ে আতিয়া নূর, দুই ভাতিজি, দুই ভাগ্নি রুখশানা জেরিন মুন্নি ও মলিসহ অন্যরা। দেশের বাইরে থাকায় শেষ দেখা করতে আসতে পারেননি কামারুজ্জামানের অন্য দুই ছেলে হাসান ইকরাম ও হাসান জামান।
বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন কামারুজ্জামানের স্বজনরা। এ সময় সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কোনো কথা না বলে শুধু বিজয় প্রতীক (ভি চিহ্ন) দেখিয়ে বেরিয়ে যান। তবে কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল বারবার ফাঁসির আয়োজন করেও পিছিয়ে যাওয়ার সরকারের নাটক বলে দাবি করেন।
কামারুজ্জামানের প্রাণভিক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি প্রাণ ভিক্ষা দেয়ার কে? প্রাণ ভিক্ষা চাইবো আল্লাহর কাছে। মুনাফিকদের কাছে কেন চাইবো?’
এরআগে বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে কারাগারে গিয়ে কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য স্বজনদের বলেন কারা কর্তৃপক্ষ। এরআগে গত ৬ এপ্রিল (সোমবার) ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তার পরিবারের সদস্যরা।
ফিরে দেখা কামারুজ্জামানের মামলা
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরেরই ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক খান পিপিএম কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের কাছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ৫ ডিসেম্বর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে জমা দেন প্রসিকিউশন। তবে সেটি সঠিকভাবে বিন্যস্ত না হওয়ায় আমলে নেয়ার পরিবর্তে ফিরিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রসিকিউশন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুনরায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। ৩১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগটি আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই বছরের ১৬ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১৬ মে আসামিপক্ষ এবং ২০ মে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেন।
২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়। ২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমান রাখেন ট্রাইব্যুনাল। ৯ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে এবং বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ২১৫ পৃষ্ঠার রায়টি ঘোষণা করেন।
ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৬ জুন আপিল বিভাগে আপিল করেন কামারুজ্জামান। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় কামারুজ্জামানের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষ হওয়ার পর গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল মামলাটির রায় অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ। ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের এ ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওইদিন দুপুরে চার বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর দেয়া শেষ করলে ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে আপিল বিভাগ থেকে ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পৌঁছে দেয়া হয় বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। একই সঙ্গে পাঠানো হয় ট্রাইব্যুনালের রায় ও অন্যান্য ডকুমেন্টস, যেগুলো আপিল শুনানির জন্য পাঠানো হয়েছিল আপিল বিভাগে।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান পূর্ণাঙ্গ রায় গ্রহণ করে মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রক্রিয়া শুরু করেন। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ট্রাইব্যুনাল-২ এর ৩ বিচারপতি মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম। পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। এরপর লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মৃত্যু পরোয়ানার সঙ্গে আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপিও পাঠান ট্রাইব্যুনাল। কারাগারে পৌঁছানোর পর কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। তিনি আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে রিভিউ আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন। আইন অনুসারে গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। পরে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতির আদালতে শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ মার্চ চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চান আসামিপক্ষ। সোমবার (৬ এপ্রিল) রায়ের দিন ধার্য করেন সর্বোচ্চ আদালত। সোমবারের রায়ে আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ায় কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় চূড়ান্তভাবে বহাল রাখেন।