সাপাহারে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ১৫ ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম আজও বিদ্যমান
নয়ন বাবু, সাপাহার, নওগাঁ : নওগাঁর সাপাহারে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করে ভূয়া তথ্য’র মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজ নাম অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণকারী চিহ্নিত ১৫ জন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদসহ তালিকা থেকে নাম বাতিলের দাবী উঠেছে। এ ঘটনায় উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিজের মান মর্যাদা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন।
উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণ কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে দাখিলকৃত অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার রসুলপুর গ্রামের (১) আব্দুস সাত্তার যার সনদ নং ম-৫৫৪০৫, তাং ১৪-০৭-২০০৪ ইং, মুক্তিবার্তা নং- ০৩০৫১১০০৭৪, (২) হাপানিয়ার আবুল কালাম (সনদ নাই), মুক্তিবার্তা-০৩০৫১১০০১২, (৩) কৈবত্য গ্রামের আব্দুল কাদের, (সনদ নাই), মুক্তিবার্তা- ০৩০৫১১০১২৪, (৪) কলমুডাঙ্গার আলতাস আলী মাষ্টার, (সনদ ও মুক্তিবার্তা নাই), (৫) রামাশ্রম গ্রামের আব্দুল করিম (সনদ ও মুক্তিবার্তা নাই), (৬) শিরন্টি গ্রামের আলাউদ্দীন, সনদ ম-৫৫০৪০, তাং- ০১-০৬-২০১৪, মুক্তিবার্তা- ০৩০৫১১০১০৩, (৭) খঞ্জনপুর গ্রামের আজিজুল হক, সনদ ম-৬৯৮৩৯, তাং- ১২-০৯-২০০৫ ইং, মুক্তিবার্তা- ০৩০৫১১০১১২, (৮) সাপাহার সদরের নুরুল ইসলাম মাষ্টার, (সনদ নাই), মুক্তিবার্তা- ০৩০৫১১০১২৫, (৯) কুচিন্দা আব্দুল মোতালেব, সনদ ম-১৫৮৭৫২, তাং- ১৯-০৯-২০১০ ইং, মুক্তিবার্তা- ০৩০৫১১০১২৯, (১০) জয়পুর ইয়াছিন আলী, (সনদ নাই), মুক্তিবার্তা- ০৩০৫১১০০২৩, (১১) ময়নাকুড়ী আজিজুর রহমান, (সনদ ও মুক্তিবার্তা নাই), শহীদ গেজেট- ২৪৭৭, (১২) তিলনা চক আফাজ উদ্দীন, (সনদ ও মুক্তিবার্তা নাই), বিশেষ গেজেট- ৩২৯৪, (১৩) বাদ-নিশ্চিন্তপুর ওসমান গণি, (সনদ ও মুক্তিবার্তা নাই), গেজেট- ৩৩৩০, (১৪) গোডাউনপাড়া লতিফুর রহমান, (সনদ ও মুক্তিবার্তা নাই), গেজেট- ২৮৪০, (১৫) কলমুডাঙ্গার মো. দুলাল (সনদ নাই), মুক্তিবার্তা- ০৩০৫১১০০১০ ব্যক্তিগণ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের কোন প্রশিক্ষন ক্যাম্পে অংশগ্রহন করেননি। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করেও তৎকালীন কমান্ডারসহ প্রশাসনকে ভূল তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম অর্š—ভুক্ত করে সনদপত্র গ্রহণ করেছেন। উপজেলার প্রকৃত সম্মুখ মুক্তিযোদ্ধাগণ এ সকল ব্যক্তিকে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অদ্য পর্যন্ত তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। অভিযোগে আরও উল্লেখ আছে, ইতিপুর্বে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কালে এ সকল কথিত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ ও নাম প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাতিল করার জন্য কমিটির নিকট কয়েক দফা অনুরোধ করা হলেও অজ্ঞাত কারনে বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এবিষয়ে উপজেলার বেশ কয়েকজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এ প্রতিবেদককে জানায়, সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক’র আমলে স্বজন প্রীতির মাধ্যমে বেশ কয়েকজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ঘটনায় ওই সময় থেকেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করতে থাকে। ফলে চিহ্নিত ওই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ সহ নাম তালিকা বাতিল করতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণ সরকারের বিভিন্ন মহলে আবেদন নিবেদন অব্যাহত রাখেন। এদিকে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলহাজ্ব ওমর আলীর আমলেও বিতর্কিত ওই তালিকার ১৫ জনের মধ্য থেকে ৬/৭ জনের নামে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকারের প্রায় ৩ লক্ষ টাকার ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন অবগত থাকলেও কথিত ওই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় সরকারি সম্মানী ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দেদারছে ভোগ করছেন। এসকল ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার লাগামহীন দৌরাত্ম্যে উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণ নিজের মানমর্যাদা রক্ষায় চরম বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। অপরদিকে কে আসল আর কে নকল মুক্তিযোদ্ধা তা নির্ণয়ে প্রশাসন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাসহ সচেতন মহলে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। গত ৮ জানুয়ারি উপজেলার আলীনগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাবুদ বক্স মুত্যুবরণ করেন একই দিনে কলমুডাঙ্গা গ্রামের কথিত মুক্তিযোদ্ধা আলতাস আলী মাস্টারও মৃত্যুবরণ করেন। পর দিন ৯ই জানুয়ারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পক্ষ থেকে এ দু’ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ঘোষনা দেয়া হয়। বেলা ২টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মাবুদ বক্সের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। বিকেল ৩ টায় আলতাস আলী মাস্টারের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ঘোষনা থাকলেও তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি। অবশেষে পরিবারের লোকজন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই তার দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এ ঘটনায় স্থানীয় সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলতাস আলীকে সম্মানী ভাতা দেয়া হলেও মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়ার প্রকৃত কারন কি?
এ বিষয়ে সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক এর সাথে ফোনে কথা হলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ২৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। ওই বাছাই কমিটির নিকট প্রার্থীত মুক্তিযোদ্ধার নাম তুলে ধরা হলে তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে ওই কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি কমান্ডারের দায়িত্বে থাকলেও ক্ষমতা ছিল ওই ২৭ সদস্যের কমিটির হাতে।
এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলহাজ্ব ওমর আলী জানান, মুক্তিবার্তা ও গেজেটের তালিকায় আলতাস আলীর নাম না থাকায় তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয় নি। মন্ত্রনালয়ের সনদ ও মুচলেকা দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা গ্রহণ করেছেন। সামনের যাচাই বাছাইয়ে সম্মানী ভাতা গ্রহণকারীগণ যদি নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমান করতে না পারেন তাহলে তাদের ভাতা বাতিল হবে।
সাপাহার উপজেলায় কথিত ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকান্ডে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক উপদেষ্টা ও উপজেলা আ’লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম। তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে যে সকল ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার নামে সনদ ও সম্মানী ভাতা দেয়া হয়েছে তা অবিলম্বে বাতিল করে উপজেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মানসম্মান অক্ষুন্ন রাখতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার রেজওয়ানুল হক জানান, মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতার ক্ষেত্রে একটি শর্ত পুরণ করে আলতাস আলী মাস্টার সম্মানী ভাতা গ্রহণ করেছেন। কোন তালিকায় তার নাম নাই। সনদের বিষয়ে মন্ত্রনালয়কে লিখিত ভাবে অবগত করা হয়েছে।